জাতিসংঘের অধিবেশন শুরু
(জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ,সোয়েব সিকদার )-শুরু হলো জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ পরিষদের মূল পর্ব। প্রতিবছরের মতো এবারও সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় মঙ্গলবার (৯ তারিখ) আনুষ্ঠানিকভাবে এ অধিবেশন শুরু হয়। তবে গতকাল মূল আয়োজনে মঙ্গলবার থেকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ভাষণ দিতে শুরু করেছেন বিশ্বনেতারা। দুই ধাপে এই বক্তৃতা অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত চলে প্রথম সেশন। এরপর দুপুরে বিরতির পর বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে দ্বিতীয় সেশন। বিতর্ক চলবে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। রোববার কোনো অধিবেশন থাকবে না। ২৯ সেপ্টেম্বর অধিবেশন শেষ হবে। বিবিসি। আলজাজিরা। সাধারণ পরিষদে প্রতিবারের মতো এবারও রাষ্ট্রপ্রধান পর্যায়ে প্রথম বক্তব্য ছিল ব্রাজিলের। প্রথাটি শুরু হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। সে বছর ব্রাজিল স্বেচ্ছায় উদ্বোধনী বক্তব্য দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। যুক্তরাষ্ট্র (আয়োজক দেশ হিসাবে) সাধারণত দ্বিতীয় বক্তা হয়। মঙ্গলবারের অধিবেশনে মূল পর্বে (হাই-লেবেল জেনারেল ডিবেট) বক্তব্য দেন-যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাত্রেঁদ্ধাসহ ১৬ রাষ্ট্রনায়ক। প্রতিটি দেশের নেতাদের জন্য ১৫ মিনিট বক্তব্যের সময়সীমা থাকে। কিন্তু দেখা যায়-সব বিশ্বনেতাদেরই বক্তব্য এই সময়সীমার চেয়ে দীর্ঘ হয়।
আয়োজনের স্থান : জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতিবছরের মতো এবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির ম্যানহাটন দ্বীপে ইস্ট রিভারের তীরে অবস্থিত। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে নির্মিত এই কমপ্লেক্সটি জাতিসংঘের মালিকানাধীন। বিশ্বের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র। তবে এ বছরের অধিবেশনে ফিলিস্তিনি প্রতিনিধিরা সরাসরি যোগ দিতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা না দেওয়ায় তারা অনলাইনের মাধ্যমে বক্তব্য দেবেন। এর আগে ১৯৮৮ সালেও অনুরূপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। জাতিসংঘের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বিরল হলেও ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা আবারও তা ঘটল।
আলোচ্য বিষয় কি : জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশন শুরু হয়েছে ‘বেটার টুগেদার : ৮০ ইয়ার্স অ্যান্ড মোর ফর পিস, ডেভলপমন্টেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ প্রতিপাদ্য নিয়ে। এবারের অধিবেশনে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র স্বীকৃতি, গাজা যুদ্ধ, ইউক্রেন সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বিশ্ব খাদ্য সংকটসহ একাধিক ইস্যুতে বিশ্বনেতারা আলোচনা করবেন।
সোমবার নিউইয়র্কে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ আয়োজনে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ফ্রান্স, আন্দোরা, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও মোনাকো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। এর আগের দিন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পর্তুগাল ও যুক্তরাজ্য একই ঘোষণা করেছিল। ফলে বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৫৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের প্রায় ৮১ শতাংশ। তবে পূর্ণ জাতিসংঘ সদস্যপদ পেতে এখনো বাধা রয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার কারণে।
বিশ্লেষকদের মতে, এ স্বীকৃতির ঢল ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বৈশ্বিক সমর্থনের নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
মানবাধিকারই শান্তির মূলভিত্তি-গুতেরেস : মূলপর্বের উদ্বোধনী বক্তব্য দেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। পরের বক্তা ছিলেন সাধারণ পরিষদের সভাপতি আন্নালেনা বায়েরবক। অধিবেশনের শুরুতেই মানবাধিকারের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন গুতেরেস। গাজায় ইসরাইল গণহত্যা করেছে-এমন অভিযোগ জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের এক তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের পর এ আহ্বানকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। গুতেরেস বলেন, ‘আমাদের মানব মর্যাদা ও মানবাধিকারকেই বেছে নিতে হবে। মানবাধিকার শান্তির অলংকার নয়, বরং সেটিই শান্তির মূলভিত্তি।’ তিনি আরও যোগ করেন-‘অধিকার বেছে নেওয়া মানে শুধু কথার কথা নয়। এর মানে হলো নীরবতার পরিবর্তে ন্যায়বিচার।’ এছাড়াও গুতেরেস সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্কে গাজা যুদ্ধ নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গাজায় ভয়াবহতা এখন তৃতীয় নিষ্ঠুর বছরে প্রবেশ করছে। এটি এমন কিছু সিদ্ধান্তের ফল, যা মৌলিক মানবতাকেও অস্বীকার করে। মহাসচিব হিসাবে আমার সময়ে এত বড় পরিসরে মৃত্যু ও ধ্বংস অন্য কোনো সংঘাতে দেখিনি।’ গুতেরেস প্রথমে সুদানের এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন নিয়ে কথা বললেও সবচেয়ে বেশি গুরত্ব দিয়েছেন গাজা যুদ্ধকে। তিনি উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ইতোমধ্যেই গাজা নিয়ে একাধিক নির্দেশ দিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ইসরাইলকে গণহত্যা ঠেকাতে ব্যবস্থা নিতে, সহযোগিতা করতে এবং মানবিক সহায়তা বাড়াতে বলা হয়েছে। তিনি আবারও নিন্দা করেন হামাসের ৭ অক্টোবরের সন্ত্রাসী হামলা ও জিম্মি নেওয়ার ঘটনাকে। তিনি বলেন, ‘কোনো কিছুই ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর সমষ্টিগত শাস্তি ও গাজার পদ্ধতিগত ধ্বংসযজ্ঞকে ন্যায্যতা দিতে পারে না।’

