অর্থনীতি

চরিত্র হারিয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলো, অবদান নিয়ে প্রশ্ন

Share this:

২০১৩ সালে অনুমতি পাওয়া চতুর্থ প্রজন্মের ৯টি ব্যাংক রক্ষা পায়নি খেলাপি ঋণের কবল থেকে। অর্থাৎ চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোতে ঋণ বিতরণের তুলনায় খেলাপি বাড়ার হার অনেক বেশি।  এতে প্রকৃত ব্যাংকের চরিত্র হারিয়েছে ব্যাংকগুলো।

খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের উন্নতিতে বড় বাধা হয়ে উঠেছে।  এক্ষেত্রে বিশেষ কোনো নতুনত্ব আনতে পারেনি চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংক। গতানুগতিক ধারায় চলছে কার্যক্রম। উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ আর আগ্রাসী ঋণ বিতরণেই ব্যস্ত তারা। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ার পাশাপাশি নানা অনিয়মেও জড়িয়ে পড়ছে ব্যাংকগুলো।

৯টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থাই নড়বড়ে; খেলাপি ঋণ ৯ হাজার কোটি টাকা তবে প্রকৃত খেলাপি কয়েকগুণ বেশি।

রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদিত কোনো ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। এর মধ্যে পদ্মা, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক।

অনিয়ম-দুর্নীতিতে তীব্র তারল্য সংকটে থাকা ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্যাংক দুটিতে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে তদন্ত চলছে। আর পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, সাবেক পলাতক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের বিশেষ ঘনিষ্ঠতার কারণে ব্যাংকটির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন নির্মোহভাবে পরিদর্শন পরিচালনা করতে পারেনি। এখন স্বাধীনভাবে পরিদর্শন করলে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংকেও স্বাধীন তদন্ত চান সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, রেমিট্যান্স আহরণ, কৃষি, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করা এবং সেবায় নতুনত্ব আনার শর্তে ২০১৩ সালে ৯টি ব্যাংক অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। শুরুতে নতুন ব্যাংকের সমালোচনা ও বিরোধিতা করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তাদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার।

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছিলেন, ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে। এসব ব্যাংক অনুমোদনের তিন বছরের মাথায় দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ শর্ত বেশির ভাগ নতুন ব্যাংক পূরণ করতে পারেনি। এক কথায়, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে বাজারে আসা চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংক রয়েছে চরম সংকটে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। তবে পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এসব ব্যাংকের খেলাপি ছিল ১১৫০ কোটি টাকা। সে হিসাবে ৭ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা বা ৮৭ দশমিক ২০ শতাংশ। অথচ এ সময় ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৫০ শতাংশ।

অর্থাৎ চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোতে ঋণ বিতরণের তুলনায় খেলাপি বাড়ার হার অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। কারণ ব্যাংকটির ৫৬৯৪ কোটি টাকা ঋণের ৪৮৮১ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে পড়েছে।

দেশে ২০১৩ সালে যাত্রার শুরু থেকেই পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) কার্যক্রম ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। যেমন অনুমোদন পাওয়ার আগেই ব্যাংকটি অফিস খুলে লোকবল নিয়োগ দিতে শুরু করেছিল। আবার সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত জমা নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন উদ্যোক্তারা। ফলে চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি।

পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির এমডি একেএম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধনসহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা।

পদ্মা ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব নেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারিতে দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। সাবেক ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়মের পর দেশছাড়া হন মহীউদ্দীন খান আলমগীর। আর জেলে আছেন নির্বাহী কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী এবং তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতী।

গত বছরের অক্টোবরে ১৬০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় তাদের ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ফারমার্স ব্যাংক নাম থাকাকালে ব্যাংকটি নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে। নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক হওয়ার পর আবার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যবহার করে নানা ছাড় নিতে শুরু করে। এতে প্রকৃত ব্যাংকের চরিত্র হারায় ব্যাংকটি।

একটি ব্যাংক টিকে থাকার মূল শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো অর্থ ও বন্ড জমা রাখা, সেটিতেও ছাড় দেওয়া হয় ব্যাংকটিকে। ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র গোপন করে আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর সুযোগও করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকটির ওপর আমানতকারীদের অনাস্থা বেড়ে যায়।

ব্যাংকটিকে ছাড় দেওয়ার কারণ ছিল, ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন। তখন বলা হয়েছিল, ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানি পদ্মা ব্যাংকের জন্য ৭০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ আনতে মধ্যস্থতা করবে, যা বাংলাদেশের ৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মতো। সমঝোতা স্মারক সই অনুষ্ঠানে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও ডেল মরগানের চেয়ারম্যান রব ডেলগাডো উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সেই বিনিয়োগ আসেনি। বরং দিনে দিনে ব্যাংকটির লোকসান বেড়েছে।

মূলত ব্যাংকটিতে ব্যাপক অনিয়ম করায় চলতি বছরের প্রথমদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে পদত্যাগ করেন নাফিজ সরাফাত। এরপর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান সোনালী ব্যাংকের এমডি আফজাল করিম। কিন্তু সম্প্রতি আফজাল করিমকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে অপসারণ করায় পদ্মা ব্যাংক এখন কার্যত নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় রয়েছে।

ইউনিয়ন ব্যাংকের বর্তমান খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের প্রায় চার শতাংশ। অথচ ব্যাংকটি তীব্র অর্থ সংকটে রয়েছে। ইতোমধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকের আগের পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন স্বাধীনভাবে তদন্তে বেরিয়ে আসবে ব্যাংকটির প্রকৃত খেলাপির চিত্র।

একইভাবে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে মাত্র ৩২৭ কোটি টাকা বা ২ শতাংশ। অথচ ব্যাংকটি তীব্র তারল্য সংকটে রয়েছে। ইতোমধ্যে এই ব্যাংকেরও বোর্ড ভেঙে পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তদন্ত শেষে প্রকৃত চিত্র জানা যাবে। এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন নিজাম চৌধুরী।

ইঞ্জিনিয়ার ফরাছত আলীর নেতৃত্বে আসা এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে মাত্র ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অঙ্কে যার পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা। যদিও পরে ফরাছত আলীকে বের করে দিয়ে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় পারভেজ তমাল। এখানেও স্বাধীনভাবে তদন্ত করলে খেলাপির প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

মেঘনা ব্যাংকের খেলাপি দেখানো হচ্ছে ২৭৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। এ বছরের জুন পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে মিডল্যান্ড ব্যাংক। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ২৩৭ কোটি টাকা। যা ৪ দশমিক ২৪ শতাংশ।

বর্তমানে মধুমতি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ। কারণ ৬ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা ঋণের ১৩৩ কোটি টাকা খেলাপি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০১৩ সালে মধুমতি ব্যাংকের অনুমোদন নেন সাবেক দক্ষিণ সিটি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। যদিও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসাবে জনৈক হুমায়ুন কবিরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে তাপস সব পর্ষদেই পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

বর্তমানে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের বিতরণের পরিমাণ ৮ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৫৪১ কোটি, যা বিতরণকৃত ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ।

২০১৩ সালে যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘদিন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন লকপুর গ্রুপের চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন। ঋণ অনিয়মের কারণে তাকে ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, এরপর তিনি বিদেশ চলে যান। পরে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হন থার্মেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির মোল্লা। কিন্তু বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করাসহ নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কাদের মোল্লা ২০২৩ সালে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। পরে এই পদে যুক্ত হন আবু জাফর মোহাম্মদ শফিউদ্দিন। আওয়ামী লীগ সরকারের এই এমপি এখন পলাতক। আর ব্যাংকটিতে পর্ষদ নিয়ে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

এছাড়া বর্তমানে এনআরবি ব্যাংকের খেলাপির পরিমাণ ৩৪৫ কোটি টাকা। যা বিতরণকৃত ঋণের ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। জানা গেছে, পরিবর্তিত সময়ে এসব ব্যাংকের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা গা-ঢাকা দিয়েছেন। ফলে ব্যাংকগুলোতে এক ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অনেক পরিচালক পদও হারাতে পারেন। কারণ তারা নানাভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *