অর্থনীতিজাতীয়সারাদেশ

সারাদেশে পণ্যবাহী নৌযান বন্ধ

Share this:

নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে বন্ধ রয়েছে সারাদেশের পণ্যবাহী নৌচলাচল। বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ ১১ দফা দাবিতে সোমবার (১৯ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে সারাদেশের নৌ-ধর্মঘটের ঘোষণা দেয় নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন। ধর্মঘটের কারণে সমুদ্র ও নদী বন্দরে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানামান কাজও বন্ধ রয়েছে। এর ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছে আমদানি রপ্তানিকারকরা। এর প্রভাবে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ীরা। একদিন পণ্য ওঠানামা বন্ধ থাকলে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি সম্মুখীন হয় বলে জানান জাহাজ মালিকরা। এদিকে নৌযান শ্রমিকদের ১১ দফা দাবি অযৌক্তিক আখ্যা দিয়েছেন কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। পৃথক ৬ দফা দাবি জানিয়েছেন জাহাজ মালিকরা।

১১ দফা দাবি নৌ-শ্রমিকদের

দাবিগুলো হলো-১. বাল্কহেডসহ সব নৌযান ও নৌপথে চাঁদাবাজি-ডাকাতি বন্ধ করা। ২. ২০১৬ সালে ঘোষিত গেজেট অনুযায়ী নৌযানের সর্বস্তরের শ্রমিকদের বেতন প্রদান। ৩. ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস এবং মালিক কর্তৃক খাদ্যভাতা প্রদান। ৪. সব নৌযান শ্রমিকের সমুদ্র ও রাত্রিকালীন ভাতা নির্ধারণ। ৫. এনডোর্স, ইনচার্জ, টেকনিক্যাল ভাতা পুনর্নির্ধারণ। ৬. কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা নির্ধারণ ৭. প্রত্যেক নৌ-শ্রমিককে মালিক কর্তৃক নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র ও সার্ভিস বুক প্রদান। ৮. নদীর নাব্যতা রক্ষা ও প্রয়োজনীয় মার্কা, বয়া ও বাতি স্থাপন। ৯. মাস্টার-চালক পরীক্ষা, সনদ বিতরণ ও নবায়ন, বেআইনি নৌচলাচল বন্ধ করা। ১০. নৌ-পরিবহন অধিদফতরে সব ধরনের অনিয়ম ও শ্রমিক হয়রানি বন্ধ ১১. নৌযান শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এ বিষয়ে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মো. শাহ আলম সংবাদকে বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে এই ১১ দফা দাবি মালিকদের বৈঠক করা হচ্ছে। কিন্তু মালিক পক্ষ আমাদের দাবি মানছেন না। সোমবার (১৯ অক্টোবর) রাতে আমরা মালিকদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় আলোচনায় আমাদের যৌক্তিক দাবি তুলে ধরেছি। কিন্তু মালিকরা আমাদের কোন দাবি মেনে না নেয়ায় আমরা ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে হয়েছে। যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা নৌযান এই ধর্মঘটের বাইরে রাখা হয়েছে। তবে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার পণ্যবাহী নৌযান এই ধর্মঘটের আওতায় রয়েছে। মালিকদের পক্ষ থেকে কোন ধরনের আশ্বাস আমরা পাইনি। প্রায় দুই লাখ শ্রমিক আমাদের এ ধর্মঘটে রয়েছেন। একই ধরনের দাবিতে গত বছরের নভেম্বরেও আন্দোলন করেছিল শ্রমিকরা। আশ্বাস পেয়ে তখন আন্দোলন থামালেও দাবি আর পূরণ হয়নি। দাবির সমর্থনে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও স্লোগানে কর্মসূচি পালন করা হবে বলে জানান তিনি।’

এগার দফা দাবি আদায়ে সোমবার (১৯ অক্টোবর) রাত ১২টা থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য পণ্য পরিবহন বন্ধ রেখেছেন নৌযান শ্রমিকরা। এই ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের বহির্নোঙ্গর এবং দেশের বিভিন্ন নদী বন্দরে অবস্থানরত জাহাজ থেকেও পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম অধিদফতরের সামনে নৌযান শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ ঐক্য পরিষদের মানববন্ধন থেকে ১১ দাবিতে এই ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছিল। এসব দাবির বিষয়ে আলোচনার জন্য সোমবার (১৯ অক্টোবর) আন্দোলনরত শ্রমিক প্রতিনিধিদের বৈঠকে ডেকেছিলেন মালিকরা। সোমবার (১৯ অক্টোবর) বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকার মতিঝিলে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে ওই বৈঠকে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক, বিআইডব্লিটিএ এর চেয়ারম্যান, শ্রম অধিদফতরের পরিচালক, নৌ-পুলিশের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। কিন্তু বৈঠক ব্যর্থ হওয়ায় রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব প্রকার পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেন শ্রমিকরা।

তবে করোনার কারণে আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়া এমনেই ক্ষতির মুখে আছে জাহাজ মালিকরা। তারপর নৌযান শ্রমিকদের এই অযৌক্তিক ধর্মঘটের কারণে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি সম্মুখীন হয় হবে জানান জাহাজ মালিকরা। এ বিষয়ে কোল্টার শিপিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শেখ মাহফুজ হামিদ সংবাদকে বলেন, করোনা সংকটের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশে এই অযৌক্তিক ধর্মঘট আহ্বান করেছে শ্রমিকরা। এর ফলে প্রতিদিন ১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে জাহাজ মালিকদের। আমার ১০টি হাজার রয়েছে মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) বন্ধ থাকার কারণে প্রায় ২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর প্রভার পড়বে নিত্যপণ্যের বাজারে। কারণে চাল, ডাল, লবণ থেকে সব পণ্য রপ্তানি করা হয়। পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকলে বাজারে এটার প্রভার পড়বে। করোনা মহামারীর মধ্যে প্রতিটি নৌ-শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়েছে। এখন তারা যা নিয়ে আন্দোলন করছে এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

৬ দফা দাবি জাহাজ মালিকদের

নৌযান শ্রমিকদের ১১ দফা অযৌক্তিক দাবি মেনে জাহাজ চলা সম্ভব নয় জানিয়েছেন জাহাজ মালিকদের সংগঠন কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) রাজধানীর বিজয়নগরে আকরাম টাওয়ামে এক সংবাদ সম্মেলনে ৬ দফা দাবি জানিয়েছেন জাহাজ মালিকরা। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সভাপতি মো. ইকবাল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুল হক ও সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম সারোয়ার আলমসহ অন্য নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ধর্মঘট পালন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও রিট মামলায় খাদ্য ভাতার ওপর নিষেধাজ্ঞা বিষয়টি সব পক্ষকে মেনে চলার অনুরোধ জানানো হয়েছে। শ্রমিকরা তা উপেক্ষা করে ধর্মঘট করছে।

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. নূরুল হক বলেন, ‘যেখানে করোনাভাইরাসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তা ছাঁটাই করা হচ্ছে বেতন অর্ধেক করা হচ্ছে। সে সময় এ ধরনের অযৌক্তিক দাবি তুলে ধরে অরাজকতার পিছনে কারও ষড়যন্ত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। মহামারীর মধ্যে শ্রমিকদের বেতন পুরোপুরি দেয়া যাচ্ছে না। তারমধ্যেই এভাবে খাদ্য ভাতার অযৌক্তিক দাবি তুলে ধরা হলে মালিকরা নিরুপায়। ধর্মঘট প্রত্যাহার করে একটি কমিটির মাধ্যমে এবং রিট মামলাটি নিষ্পত্তি করে আলোচনায় বসতে হবে।

কিছু কিছু কোম্পানির মালিক খাদ্য ভাতা দিতে রাজি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওইসব কোম্পানির জাহাজ সিরিয়াল না ধরে মাসে চার থেকে পাঁচটি ভাড়া নেয়। তাদের আয় বেশি। কিন্তু আমরা সিরিয়াল ধরে তিন মাসে একটি ভাড়া পাই। যেসব কোম্পানি শ্রমিকদের খাদ্য ভাতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তারা এ সংগঠনের অধীনের নয়।

সংবাদ সম্মেলনে ৬ দফা দাবি জানায় পণ্যবাহী জাহাজ মালিকরা। তাদের দাবিগুলোর হলো- ১. নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের ধর্মঘট পালন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও রিট মামলায় খাদ্য ভাতার ওপর নিষেধাজ্ঞা বিষয়টি সব পক্ষকে মেনে চলার অনুরোধ। ২. ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নীতিমালা উপেক্ষা করে চলাচলরত সিরিয়াল বিভিন্ন জেলায় কর্মরত শ্রমিকদের কম্পিউটার সার্টিফিকেট বাতিল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৩. শ্রমিক নামধারী কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসী কর্তৃক জোরপূর্বক স্বাভাবিক জাহাজ চালানোর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, নৌপথে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৪. সরকারি গেজেট মোতাবেক ২০২১ সাল পর্যন্ত শ্রমিক সংগঠনের অবৈধ দাবি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ৫. নৌযান শ্রমিকদের সাহায্যে সার্ভিসটি বিভিন্ন অবৈধ জাহাজ চালানো বন্ধ করতে হবে। ৬. সমুদ্রে বহির্নোঙ্গর হতে অবৈধ বাল্কহেডের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন বন্ধ করতে হবে।

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর

পণ্যবাহী নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর এবং বিভিন্ন ঘাটে অবস্থানরত জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। তবে বন্দরের জেটিতে কন্টেইনার জাহাজে পণ্য ওঠানামা অব্যাহত আছে। সাধারণত বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য নিয়ে কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঘাটে তা খালাস করে লাইটারেজ জাহাজ। ধর্মঘটে তা বন্ধ রেখেছেন শ্রমিকরা। এ বিষয়ে নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক নবী আলম বলেন, ‘সোমবার রাত ১২টা থেকে সমস্ত লাইটার চলচাল বন্ধ রাখা হয়েছে। যতক্ষণ ১১ দফা দাবি মানা না হবে, ততক্ষণ ধর্মঘট চলবে। দুই বছর ধরে আমাদের এ আন্দোলন চলছে। চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় এক হাজার ছয়শ’ লাইটার জাহাজ চলাচল করে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাদের প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক এবং সারাদেশে মোট দুই লাখ শ্রমিক আছে এই ধর্মঘটে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজগুলো অপেক্ষমাণ আছে। সেগুলোর কোনটিতেই লাইটার যায়নি। তাই পণ্য খালাসের কাজ বন্ধ আছে। ধর্মঘটের কোন প্রভাব কন্টেইনার জেটিগুলোতে পড়েনি। সেখানে কন্টেইনারবাহী জাহাজ থেকে কন্টেইনার ওঠানামার কাজ চলছে।’

মোংলা সমুদ্র বন্দর

নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘটে বাগেরহাটের মোংলা বন্দরেও পণ্যবাহী জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রয়েছে। নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের মোংলা উপজেলা শাখার সহ সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান বাবুল বলেন, এ বন্দরে ‘সহস্রাধিক’ পণ্যবাহী নৌযানে ১৪ থেকে ১৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তারা সবাই কাজ বন্ধ রেখেছেন। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।’ মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার মো. ফকর উদ্দিন বলেন, সার, কয়লা, পাথরবাহী মোট ১৫টি দেশি বিদেশি জাহাজ বর্তমানে মোংলা বন্দরে অবস্থান করছে। এরমধ্যে পাঁচটি জাহাজের পণ্য ওঠানামার কাজ শেষ হয়েছে। মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) সেগুলো বন্দর ত্যাগ করবে। নতুন করে মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) আরও তিনটি জাহাজ আজ বন্দরে ভেড়ার কথা। নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট শুরু হওয়ায় এখন পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রয়েছে। ধর্মঘট দীর্ঘায়িত হলে বন্দরে জাহাজ জট বাড়বে, আমদানি রপ্তানিকারকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *