আন্তর্জাতিক

নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে বিদেশি কূটনীতিকেরা

Share this:

(Soyeb Sikder ,Senior Reporter)-সরকারের পদত্যাগের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাজধানীর কূটনীতিকপাড়ার আশপাশে অফিস, বাসাবাড়িতে আগুন ও ভাঙচুরের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের অভাবে কূটনীতিকপাড়া কিছুটা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে, যা কূটনীতিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। যদিও সরকার বিকল্প হিসেবে কূটনীতিকপাড়ায় চার প্লাটুন সেনা মোতায়েন করেছে। কূটনীতিকপাড়ায় বিদেশি মিশনগুলোর জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ দিতে না পারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

অন্যদিকে এই মুহূর্তে সরকার না থাকা এবং দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলাজনিত যে সমস্যা হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে যা ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কীভাবে দেবে, সেটাও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ঢাকায় এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে কর্মরত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ‘দ্রুত পরিবর্তনশীল টালমাটাল পরিস্থিতির’ সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে কর্মকর্তাদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন। ওই বার্তায় তিনি সহকর্মীদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘মনে রাখবেন সংকটের মুখে বিচক্ষণতার পরিচয় সাহসিকতার সবচেয়ে ভালো দিক।’

এদিকে দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের করণীয় বিষয়ে গত মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অনুবিভাগ) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম।

জানতে চাইলে খুরশেদ আলম বুধবার রাতে বলেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে ও দেশের বাইরে কূটনীতিকদের বিষয়ে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কূটনীতিকদের কাজটি পেশাগত দিক থেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা বলে সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নিয়ে দায়িত্বশীলভাবে দায়িত্ব পালন করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

নিরাপত্তা নিয়ে কূটনীতিকদের উদ্বেগ

বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নিরাপত্তা নিয়ে বিদেশি মিশনগুলোর মধ্যে একধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের জরুরি নয় এমন অনেক কর্মকর্তাকে বুধবার দিল্লিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাত দূতাবাস গত মঙ্গলবার তাদের নাগরিকদের যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে। একান্ত জরুরি না হলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে।

গত মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে কূটনৈতিকপাড়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই এলাকায় যে অগ্নিকাণ্ডগুলো হয়েছে, যেসব বাড়িঘর ও অফিস পোড়ানো হয়েছে, সেগুলোতে কূটনীতিকেরা বেশি আতঙ্কিত হয়েছেন। এর ব্যাখ্যা বাংলাদেশ কীভাবে দেবে, এমন আলোচনাও হয়েছে বলে একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান।

জানা গেছে, ঢাকায় রাষ্ট্রদূত যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা পুলিশ পাচ্ছেন না। বিশেষ করে তাঁরা দপ্তর ও বাসায় বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রয়োজনের তুলনায় পুলিশ পাচ্ছেন না। এ জন্য তাঁরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁদের পুলিশ নেই, তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

কূটনীতিকপাড়ার নিরাপত্তার বিষয়ে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বৈঠকে বলেন, ওই এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় পুলিশ এই মুহূর্তে কম রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কিছুটা দ্বিধায় আছে পুলিশ। তবে কূটনীতিকপাড়ায় পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেখানকার সবগুলো প্রবেশপথে এপিসি মোতায়েন করা হয়েছে।

বৈঠকে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে পড়তে আসা বিদেশি কূটনীতিক শিক্ষার্থীদের আতঙ্কে দিন কাটানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তাদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয় নিয়ে কর্মকর্তারা আলোচনা করেন। ফরেন সার্ভিস একাডেমির গেট সব সময় বন্ধ রাখা, তাঁরা যেন বাইরে না যান, রাতে আলো নিভিয়ে রাখার পরামর্শ দিতে বলা হয়েছে।

কূটনীতিকদের দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ

৫ আগস্ট দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে মঙ্গলবারের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল একটি অস্থির পরিস্থিতি থিতু হতে সময় লাগতে পারে। তাই দেশের বাইরের মানুষের কাছে নিজের মতামত তুলে ধরার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সংযত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। নিজেদের মতামত সামাজিক পরিসরে না দিতে বলা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবেগপূর্ণ স্ট্যাটাস দেওয়া থেকে বিরত থাকার বিষয়ে সতর্ক করে মো. খুরশেদ আলম বলেন, ‘আমাদের পেশাদারি কাজটি করতে গিয়ে এমন কোনো কাজ বা এমন কোনো স্ট্যাটাস আমরা যেন না দিই। সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে আমাদের যা করণীয়, তার বাইরে অন্যরা এটিকে দেখতে পারে। এটি যেন না হয়।’

মো. খুরশেদ আলম বলেন, ‘গতকাল এমনিতেই যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, সবগুলোই যে আমরা উত্তর দিয়ে মোকাবিলা করতে পারব, তা কিন্তু নয়। অনেক কিছু রয়েছে, যা আমাদের মোকাবিলা করার বাইরে চলে গেছে। এটি আমাদের জন্য ভালো না খারাপ, সে হিসাবে যাব না। আমাদের কাজ হলো যে সরকার আসবে, তাদের হয়ে কাজ করা।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ বছর ধরে একটি সরকার ক্ষমতায় ছিল। টানা চারবার একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকার কারণে দীর্ঘদিন ধরে একই সরকারের ভাষ্য বা ব্যাখ্যা বাইরের বিশ্বে প্রচার করেছেন কর্মকর্তারা। ফলে ক্ষমতার যে পালাবদল ঘটেছে, তার সঙ্গে এখনকার কর্মকর্তাদের বড় অংশই পরিচিত নয়। ফলে এ সময়ে কীভাবে আচরণ করাটা সংগত, তা নিয়ে আলোচনা হয়।

আলোচনার এক পর্যায়ে মেরিটাইম অনুবিভাগের সচিব নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ’৯১ সাল থেকে পরবর্তী শাসনামলগুলোর পরিবর্তনের পর্বে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যে ঘটনা ঘটেছে, তা কিন্তু প্রথম নয়। আমি ১৯৯৬ সালে দেখেছি, তখন উনিও (খালেদা জিয়া) এভাবে ক্ষমতা থেকে চলে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া ১৯৭০, ১৯৭১ সালে হয়েছে, কিন্তু দেশের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়নি। কিন্তু প্রতিক্রিয়া হয়েছে ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ সালে যখন সরকার পরিবর্তন হলো, এরশাদ চলে গেলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এল, তখনো কিন্তু এ রকম মারামারি, এটা-সেটা ঘটেছে। আবার যখন সরকার পরিবর্তন হলো এ ধরনের (সহিসংতা) হয়নি, তা কিন্তু নয়। এটা আমরা অতীতেও দেখেছি। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে সোমবার যা হয়েছে, তা প্রথমবার বাংলাদেশে হয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *