সম্পাদকীয়সারাদেশ

গাজী-কালু ও চম্পাবতীর ইতিহাস

Share this:

(শোয়েব সিকদার) -প্রেমিকার টানে দরবেশ হয়ে নিজ এলাকা ছাড়েন গাজী। এদিকে মুসলমান পাত্র দেখে হিন্দুরাজাও মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দেবেন না বলে জানায়। এরপর প্রেমিকা চম্পাবতীকে উঠিয়ে নিয়ে বনে-বাদারে ঘুরতে থাকেন গাজী। তার সঙ্গী তখন কালু আর দক্ষিণ রায়। শাহ গাজী, কালু ও চম্পাবতীর পরিচয় নিয়ে আছে নানা ইতিহাস। জনশ্রুতি আছে বৈরাগ নগরের শাসক দরবেশ শাহ সিকান্দারের ছেলে শাহ গাজী। কালু ছিলেন শাহ সিকান্দারের পোষ্যপুত্র। আর চম্পাবতী ছিলেন সাপাই নগরের সামান্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার মেয়ে। 

প্রথম দেখাতেই শাহ গাজী আর চম্পাবতী একে অন্যের প্রেমে পড়ে যায়। ভুলে যান নিজেদের জাত, ধর্ম, স্থান, কাল। তাদের মিলনের মাঝে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি। ছাপাই নগরের বলিহর বাওরের তমাল গাছ তলায় গাজী নিয়মিত অপেক্ষা করতেন চম্পাবতীর জন্য। তার সার্বোক্ষণের সঙ্গী ছিলেন কালু। তাদের দু’জনের ছিল গলায় গলায় ভাব। 

চম্পাবতীর পিতা মুকুট রায় ছিলেন ১৪ শতকের প্রথমার্ধের প্রতাপশালী রাজা। যার রাজ্য ছিল দক্ষিণে সুন্দরবন ও পশ্চিমে হুগলি পর্যন্ত বিস্তৃত। পাবনা, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, নদীয়া, বর্ধমানের বিস্তৃত এলাকায় দাপটের সঙ্গেই জমিদারি করেছেন এই ব্রাহ্মণ। তার রাজধানী ছিল ঝিকরগাছা সদর থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে লাউজানিতে। মুকুট রাজা ঝিনাইদহ, কোটচাঁদপুর, বারোবাজারের পূর্ব এলাকা ও বেনাপোল অঞ্চলের সামন্ত রাজা ছিলেন। তিনি রামচন্দ্র বা শ্রীরাম নামেও পরিচিত।

এই রাজার চারটি বাড়ি ছিল- ঝিনাইদহের বাড়িবাথান, বারোবাজারের ছাপাইনগর (বর্তমানে বাদুরগাছা), কোটচাঁদপুরের জয়দিয়া বাঁওড়ের বলরামনগর ও বেনাপোলের কাগজপুকুরে। সুন্দরবনের বাঘের দেবতা হিসেবে পূজিত ব্রাহ্মণ দক্ষিণ রায় ছিলেন এই মুকুট রায়েরই সেনাপতি। মুকুট রাজা তার সেনাপতিদের হুকুম দেন, গাজী ও কালুকে শায়েস্তা করতে। যুদ্ধে মুকুট রায়ের সেনাপতি দক্ষিণা রায় পরাজিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে গাজীর অনুসারী হন। অতঃপর গাজী মুকুট রায়কে পরাজিত করে তিনি চম্পাবতীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজারে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা দু’জনে সেখানেই ছিলেন। 

ঝিনেইদহের বারবাজার ইউনিয়নের বাদুরগাছা গ্রামে শ্রীরাম রাজার বীর দিঘির দক্ষিণ পাশে তিনটি পাশাপাশি কবরের অবস্থান। পশ্চিম দিকের কবরটি কালুর, পূর্ব পাশের কবরটি চম্পাবতীর আর মাঝখানের কবরটি গাজীর কবর বলে পরিচিত। এছাড়াও আরেকটি সমাধি আছে সেখানে। ধারণা করা হয় সেটি দক্ষিণ রায়ের।  

ঝিনাইদহে আসার পর গাজী, রাজার সেনাপতি গয়েশ রায়ের প্রমোদ ভবন জালিবল্লা পুকুরের পাড়ে বদমতলীতে ছাঁউনি ফেলেন। এরপর রাজা চলে যান জয়দিয়া বাঁওড়ের বাড়িতে। এ বাড়ির অবস্থান দেখলে মনে হয়, রাজা অত্যন্ত সৌখিন ছিলেন। জয়দিয়ার বাঁওড় একসময় ভৈরব নদের অংশ ছিল। বাঁওড়ের পূর্বপাড়ে ছিল রাজার বাড়ি। বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে বলহর বাঁওড়। যা এক সময়ে কপোতাক্ষ নদের অংশ ছিল। দুই বাঁওড় তথা দুই নদীর মধ্যস্থলে অবস্থিত এই রাজবাড়ির গুরুত্ব অপরিসীম। দক্ষিণ পাশে বাঁওড়ের কূল ঘেঁষে তমাল গাছের নিচে আজো গাজীর দরগা বিদ্যমান। 

শাহ গাজীর প্রকৃত নাম গাজী মিয়া বা বড়খান গাজী। তার পিতার মৃত্যু হয় ১৩১৩ সালে। সেসময় তিনি ছিলেন ত্রিবেনী ও সপ্তগ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্তা। বাল্যকালেই ফকির-দরবেশের সাহচর্যে আধ্ম্যাতিক সাধনায় উন্নতি লাভ করেন গাজী। পিতার কাছে শাসন ক্ষমতা নিতেও অস্বীকার করেন তিনি। ইসলাম প্রচার শুরু করেন দক্ষিণ বঙ্গের যশোর-খুলনা অঞ্চলে। ধর্ম প্রচারে বাধা প্রাপ্ত হয়ে রাজা মুকুট রায়ের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয় তার। তখনই হয়ত তার চম্পাবতীর সঙ্গে দেখা হয়।

অবশেষে গাজী অনুসারীদের নিয়ে বহু খণ্ড যুদ্ধের পর উদ্ধার করে চম্পাবতীকে। এরপর তারা বারোবাজার ফিরে এসেছিলেন। তবে গাজীর বাবা শাহ সিকান্দার বিষয়টা একেবারেই মেনে নেননি। মুকুট রাজা ছিলেন তারই প্রতিবেশী শাসক। হিন্দু সমাজের অসন্তুষ্টির কারণে তিনি গাজীকে বাড়িতেই উঠতে দেননি। বিতাড়িতও করেন সমাজ থেকে। তবে এখানে এসে গাজী পীর লোকজ দেবতা হিসেবে পূজিত হন। 

হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত সুন্দরবনের সবাই তাকে স্মরণ করে। যে কেউ সুন্দরবনে ঢোকার আগে হাতজোড় করে বনবিবির পাশাপাশি গাজীর নামে দোহাই দিয়ে ঢোকে। সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়গুলোতে সাদা বর্ণের মুখে দাড়িসহ কোথাও জামা-পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ মূর্তি, কোথাও লুঙ্গি পরা ঘাড়ে গামছাসহ মূর্তি পূজিত হয়। এই পূজার নিরামিষ নৈবেদ্য হলো বাতাসা, পাটালি, আতপচালের শিরণি ইত্যাদি। গ্রামের সাধারণ মানুষ জঙ্গলে প্রবেশ ছাড়াও গৃহপালিত পশুপাখি কামনা করেও গাজী সাহেবকে স্মরণ করে থাকেন।

এদিকে পুঁথি সাহিত্যের তথ্য অনুযায়ী, মুকুট রায়ের স্ত্রী লীলাবতীর সাত পুত্র। এক কন্যা চম্পাবতী বা শুভদ্রা। তার রূপের খ্যাতি ছিল জগৎজোড়া। এ নিয়ে পিতা মুকুট রায়ের গর্বও ছিল সীমাহীন। সেই কন্যার প্রেমে পড়েন গাজী। তবে চম্পাবতীর রূপে গাজীর এভাবে চেতনা হারানোর ঘটনাকে অলীক বলেই মনে করেন এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত সাতক্ষীরার পুরাকীর্তি বইয়ের লেখক মিজানুর রহমান। তার যুক্তি, পুঁথিতেই আছে গাজী ছিলেন সংসার বিবাগী মানুষ। তাই চম্পাবতীর রূপ দেখে গাজীর মুর্চ্ছিত হওয়ার কথা নয়। এমনকি চম্পার জন্য তার যুদ্ধে লিপ্ত হওয়াটাও অস্বাভাবিক। কার্যত মুকুট রায়ের কাল হয় জাতিবিদ্বেষ।  

লেখক মিজানুর রহমানের মতে, ভাই কালুকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মুকুট রায়ের দরবারে পাঠিয়েছিলেন গাজী। তবে মুকুট রায় তাকে বন্দি করেন। এরই জেরে ঝিকরগাছার লাউজানিতে মুকুট রায়ের সঙ্গে গাজী পীরের যুদ্ধ হয় ১৩৬৫ সালে। গাজীর দল যুদ্ধে জেতে। মুকুট রায় সপরিবারে আত্মহত্যা করেন। তার কনিষ্ঠ পুত্র কামদেব ও চম্পাবতী বন্দি হন গাজী বাহিনীর হাতে। পরে ইসলাম গ্রহণ করে কামদেব হন পীর ঠাকুর। আর ভক্তদের অনুরোধে চম্পাকে বিয়ে করেন গাজী।

পরবর্তীতে গাজীর নামেই গড়ে ওঠে গাজীর হাট, গাজীপুর, গাজীর জাঙ্গাল, গাজীডাঙ্গা, গাজীর ঘাট, গাজীর দেউল, গাজীর খাল, গাজীর ঘুটো ইত্যাদি এলাকা। কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গল কাব্যেও চম্পাবতীর পরিচয় ও বিয়ের গল্প একই। তবে কেউ কেউ দাবি করেন, মুকুট রায় নিজেই নাকি চম্পাকে গাজীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। 

ঝিনাইদহ জেলার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যশোর মহর থেকে ১১ মাইল উত্তরে বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার অন্তর্গত কালীগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক বারবাজার অঞ্চলে যেসব আধ্যাত্মিক সাধক ইসলাম প্রচারে অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে গাজী, কালু ও চম্পাবতী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের সঠিক পরিচয় নিরূপণ করতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা নানা মত পোষণ করেছেন। 

ঐতিহাসিক শতীশ চন্দ্র মিত্রের মতে, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বিশেষ অবদান রাখেন গাজীর পিতা সিকান্দার। তার ছেলের নাম বরখান গাজী। তিনি সাধারণত বরখান গাজী ও বড় গাজী বা গাজী সাহেব নামে পরিচিত। তিনি সুন্দরবন অঞ্চলের রাজা মুকুট রায়কে পরাজিত করে তার মেয়ে চম্পাবতীকে বিয়ে করেন। ঐতিহাসিক বারবাজার বার আউলিয়ার স্মৃতি বহন করে চলেছে। তুর্ক-আফগান আমলে এখানে মুসলিম সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত ছিল। 

গাজী-কালুর কথা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জনশ্রুতি আছে, গাজী কালুর আধ্যাত্মিক প্রভাবে বাঘে ও কুমির একঘাটে জল খেত! গাজী কালু এমনই স্বনামধন্য ঐতিহাসিক চরিত্র। হিন্দু ধর্মবলম্বলীরা বনদূর্গার বদলে যাদের পূজা করে তাদের মধ্যে গাজী-কালু অন্যতম। গাজী-কালুকে নিয়ে অনেক মিথ বা গল্প প্রচলিত। অনেক কবিতা ও পুঁথির মাধ্যমে তার ভাব প্রকাশ হয়েছে যুগে যুগে আসলে ইতিহাস সন্ধান আমার কাজ না হলেও সে সব বাদ দিয়ে চলা মুশকিল। তবে সারাদেশের শহর-গ্রামে ব্যাপকভাবে প্রচলিত গাজী-কালু-চম্পাবতীর গল্প-কাহিনী। এর সত্যতা নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে নিয়ে বিশেষজ্ঞ-ইতিহাসবিদদের অনেক মতভেদ আছে।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারের পূর্বপাশে সামান্য একটু দূরে গাজী কালু-চম্পাবতীর মাজার অবস্থিত। এই মাজারের গা ঘেঁষে রয়েছে ছয়টি ছোট-বড় বটবৃক্ষ। প্রত্যেকটির গোড়া শান দিয়ে ঘেরা! এই গাছগুলোতেই বাঁধা হয় রংবেরঙের পলিথিন। মনের ইচ্ছে পূরণে একধরনের বিশ্বাসী মানুষেরা এগুলো বেঁধে রাখেন! 

গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজারে হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করে। মাজার সন্নিহিত দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি প্রাচীন বটগাছ আছে। এই বটগাছের তলদেশে একটি শূণ্যস্থান দেখা যায়। এটিকে অনেকে প্রাচীন কূপ কিংবা অন্য কোনো কবর বলে মনে করেন। ১৯৯২ সালে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসন কবর তিনটি বাঁধাই করে বেষ্টনি প্রাচীর নির্মাণ ও খাদেমদের থাকার জন্য সেমিপাকা টিনশেড তৈরি করে দেয়। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *