পরকীয়ায় বাঁধা দেয়ায় দুই সন্তানের জননীকে পুড়িয়ে মারলো স্বামী
স্বামীর পরকীয়ায় বাঁধা দেওয়ার দুই সন্তানের জননী ও তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ ইসরাত জাহান ইমাকে (৩০) হাত ও পা বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে পাষন্ড স্বামী। নির্মম এই ঘটনাটি ঘটেছে জেলার নদীবেষ্টিত হিজলা উপজেলার বড়জালিয়া ইউনিয়নের খুন্না গবিন্দপুর গ্রামের টেকের বাজার সংলগ্ন এলাকায়।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে হিজলা থানার ওসি অসীম কুমার সিকদার জানান, ঘটনাটি তার থানার মধ্যে হলেও রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ জুন গৃহবধূ ইমা মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি আরও জানান, ঘটনার বিষয়ে আগে কেউ থানায় অভিযোগ না করেই নিহত গৃহবধূকে দাফন করেছেন। পরবর্তীতে মৃত্যুর পূর্বে হাসপাতালে শষ্যাশয়ী ওই গৃহবধূর মায়ের মোবাইল ফোনে ধারণকৃত ১১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও রেকর্ডে হত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি উঠে এসেছে।
ওসি বলেন, ভিডিও রেকর্ডের উপর ভিত্তি করে গত ২১ জুন নিহতের পিতা শফিকুল ইসলাম মাসুম বাদি হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় নিহতের পাষন্ড স্বামী মহসিন রেজা, ভাসুর মোস্তফা বেপারী, শশুড় দেলোয়ার হোসেন বেপারী ও পরকীয়া প্রেমিকা শাহনাজ বেগমকে আসামি করা হয়েছে। তবে মামলার বিষয়টি টের পেয়েই আসামিরা নিজ এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করলেও তাদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে।
নিহতের চাচা মাজহারুল ইসলাম জানান, গত আট বছর পূর্বে সামাজিকভাবে উপজেলার হরিনাথপুর ইউনিয়নের মহিষখোলা গ্রামের শফিকুল ইসলাম মাসুমের কন্যা ইসরাত জাহান ইমার বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী বড়জালিয়া ইউনিয়নের খুন্না গবিন্দপুর টেকের বাজারের মুদি ব্যাবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বেপারীর পুত্র মহসিন রেজার সাথে। আট বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের পাঁচ বছরের একটি কন্যা ও দেড় বছরের পুত্র সন্তান রয়েছে। তাছাড়া ইসরাত জাহান ইমা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো।
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি সময়ে মহসিনের খালাতো বোন শাহনাজ বেগমের সাথে মহসিন রেজার পরকীয়া সর্ম্পক গড়ে ওঠে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর থেকে মহসিন ও ইমার দাম্পত্য জীবনে কলহ শুরু হয়। এনিয়ে প্রায়ই ইমাকে তার স্বামী শারীরিক নির্যাতন করে আসছিলো। সবশেষ গত ১০ জুন একই বিষয় নিয়ে তাদের স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে তুমুল বাগ্বিতন্ডা হয়। খবর পেয়ে ইমার মা ইয়াসমিন বেগম মেয়ের স্বামীর বাড়িতে যান। এমনকি ওইদিন শাশুড়ির সামনেই স্ত্রীকে মারধর করে মহসিন রেজা।
এ ঘটনার পরেরদিন ১১ জুন ইমা’র মা বাড়ি চলে যায়। ওইদিন বিকেলে স্থানীয় শিপন ও রফিক নামের দুই যুবক অগ্নিদগ্ধ ইমাকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলেও স্ত্রীর খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেনি মহসিন রেজা। ফলে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। উল্টো মহসিন তার শ্বশুরকে ফোন করে জানায় গ্যাসের চুলায় অগ্নিসংযোগে ইমা মারা গেছে।
পরবর্তীতে ইমার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় প্রথমে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এবং পরবর্তীতে ওইদিন রাতেই এ্যাম্বুলেন্সযোগে রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে নিয়ে ১২ জুন সকালে ইমাকে ভর্তি করেন। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ জুন সকালে ইমা মুত্যুরকোলে ঢলে পরেন।
ইমার চাচা মাজহারুল ইসলাম আরও জানান, মৃত্যুর পূর্বে ইমা তার উপর নির্যাতন এবং পুড়িয়ে মারার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। যার ১১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও রেকর্ড রয়েছে। এরপরেও ইমার মাকে শাহাবাগ থানায় কর্মরত এক পুলিশ কনস্টেবলের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে মৃতদেহ নিয়ে আসা হয়। তাই হত্যার বিষয়টি গোপন করে দুর্ঘটনার কথা বলে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট থেকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মৃতদেহ হিজলায় এনে দাফন করা হয়েছে।
গৃহবধূর মৃত্যুর পূর্বে রেখে যাওয়া ভিডিও রেকর্ডিং গত কয়েকদিন পূর্বে ছড়িয়ে পরলে পুরো উপজেলাজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এটি দুর্ঘটনা নয়, বরং হত্যা বলে গুঞ্জন ওঠে। ভিডিও রেকর্ডে শোনা যায় গৃহবধূ বলেন, পরকীয়া প্রেমের জেরধরে প্রথমে তাকে চেয়ার দিয়ে পিটিয়ে আহত করা হয়। তিনি অচেতন হয়ে পরার পর তার হাত-পা বেঁধে শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তিরা জানান, একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন ইমা ও তার স্বামী। ঘটনারদিন বিকেলে ইমার চিৎকারে ওই ভবনের দুই প্রতিবেশী ঘটনাস্থলে ছুটে এসে ইমাকে আগুনে পুড়তে দেখে নিজেদের ঘর থেকে পানি এনে তা দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলেন। এ সময় ইমার স্বামী ঘটনাস্থলে জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিলো।
হিজলা থানার ওসি অসীম কুমার সিকদার বলেন, আমরা ১১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও রেকর্ড পেয়েছি। যেখানে ইসরাত জাহান ইমা মৃত্যুর কিছুটা বর্ণনা দিয়ে গেছেন। এতে কিছুটা হলেও তার স্বামীকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। ওসি আরও বলেন, ইতোমধ্যে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ আসামিদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে গৃহবধূর মৃতদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।