বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার চাহিদা
কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষাকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কিন্তু বিভিন্ন কারণে কাঙ্ক্ষিত গুণগত মানের দক্ষতা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। বাস্তব কর্মক্ষেত্র থেকে প্রায়ই প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাবের কথা বলা হয়ে থাকে। ফলে ভারতসহ বহু দেশের লোক বাংলাদেশে কাজ করছেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন।
*** সরকারি ও বেসরকারি খাতে কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট সম্প্রসারণ হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৬৭৫টি কারগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই স্তরে শিক্ষার্থী বাড়ছে। সরকার ২০২০ সালে মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ২০ শতাংশ (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে) এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। বর্তমানে এই হার প্রায় ১৬ শতাংশ। কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়। এ ছাড়া বিএম, ভোকেশনাল, কৃষি ডিপ্লোমা রয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, যারা এসব কোর্স করছে, তাদের সহজেই কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক থাকলেও তাদের বেকার থাকতে হচ্ছে না।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ। তাদের কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অনেক বেশি। তা ছাড়া বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও দক্ষ জনবলের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষাকে অর্থবহ করার জন্য কারিগরি শিক্ষার আরও সম্প্রসারণ এবং মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে কারিগরি শিক্ষাকে উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতের কাছে নেওয়া হয়েছে। আশা করা যায়, গ্রামগঞ্জের মেধাবী ছেলেমেয়েরা এতে উৎসাহিত হবে।
প্রতিটি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করে শুরু থেকেই দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক কাজ সম্পর্কে সব ছাত্রছাত্রীর প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাড়ির দৈনন্দিন ছোটখাটো কারিগরি কাজ নিজে নিজে করার জন্য দেশের সব স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীকে এ সম্পর্কে শেখানো প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে স্কুল পর্যায়ে পাঠ্যক্রমে কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। অবশ্য পত্রিকায় খবর অনুযায়ী, সরকার কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলকভাবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করতে যাচ্ছে। ২০২১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, ২০২২ সালে সপ্তম শ্রেণিতে এবং ২০২৩ সালে অষ্টম শ্রেণিতে প্রাক্বৃত্তিমূলক শিক্ষা হিসেবে একটি কারিগরি বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা হবে। অন্যদিকে নবম-দশম শ্রেণিতে ২০২১ সালে বাধ্যতামূলকভাবে একটি কারিগরি বিষয় চালু হবে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক খবর।
কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর লক্ষ্যে তাদের জন্য আরও পলিটেকনিক ও টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজকে ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। ছাত্রীদের অধিকতর বৃত্তি–উপবৃত্তি প্রদান এবং পড়াশোনা শেষে চাকরিপ্রাপ্তি সহজতর করা প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা দিন দিন বাড়ছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কিন্তু বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো ও ল্যাবগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো ও ল্যাব উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও কার্যকর শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। তা ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তিসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হলে তাদের অংশগ্রহণ বাড়বে।
যুগের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া বর্তমানে চালু সিলেবাসগুলোকে যুগের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিকীকরণ ও সংশোধন করা প্রয়োজন। বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘দক্ষতাভিত্তিক’ প্রশিক্ষণ সব ক্ষেত্রে চালু করা হলে দক্ষতার সার্বিক উন্নয়ন হবে। তা ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংখ্য লোক অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজে দক্ষতা অর্জন করেন কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পান না। তাঁদের স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা হলে তাঁদের মর্যাদা বাড়বে এবং বিদেশেও ভালো চাকরি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কারিগরি শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মেধাবীদের আগ্রহী করার লক্ষ্যে কারিগরি সনদধারীদের উচ্চশিক্ষার অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
কারিগরি শিক্ষা বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়। স্থানীয়ভাবে সুপারিশের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। আশার কথা হলো, ধীরে হলেও পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে।
***কারিগরি শিক্ষা
বিশ্ব বনাম বাংলাদেশ
ভোকেশনাল এডুকেশন বা কারিগরি শিক্ষা এমন এক শিক্ষা পদ্ধতি যেখানে পাস-ফেল বলে কিছু নেই। বরং এটি একজন মানুষকে যোগ্য প্রতিযোগী করে গড়ে তোলার এক প্রয়াস, যেখানে হয় আপনি যোগ্য অথবা এখনও যোগ্য নন।তাই পরিপূর্ণ দক্ষতা অর্জনের জন্য এবং একজন যোগ্য প্রতিযোগী হতে আপনাকে যতবার প্রয়োজন ততবার পরীক্ষা দেবার এবং নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ দেয়া হয়।কারিগরি শিক্ষায় তত্ত্বীয় পড়াশুনার চেয়ে বাস্তব প্রয়োগে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, যাতে করে একজন কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি নিজের যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজের সুযোগ খুঁজে নিতে পারে ।বাস্তব কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় কারিগরি শিক্ষাকে চাকুরির ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। একজন চাইলে খুব সহজেই কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের পূর্বের কাজ থেকে বেরিয়ে নতুন কাজ করতে পারে এবং নিজের ক্যারিয়ার কে সমৃদ্ধ করতে পারে।প্রতিযোগিতার বাজারে কারিগরি শিক্ষা যোগ্য প্রতিযোগী তৈরিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সমমানের শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি এই পদ্ধতি কার্যকর এবং যুগোপযোগী। শিক্ষায় উন্নত দেশগুলোতে আমরা কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রমের প্রসারিত চিত্র দেখতে পাই।
***দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই
বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার প্রয়োজন। এর মাধ্যমে প্রয়োজন মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদের দক্ষতা বাড়িয়ে দারিদ্র্য বিমোচন, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। এ লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪০ সালের মধ্যে এ হার যথাক্রমে ২০, ৩০ ও ৪০ শতাংশে উন্নীত করবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য দেশে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও তার আলোকে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনসহ নতুন নতুন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে। তার পরও বলতে হচ্ছে, দেশে কারিগরি শিক্ষার হার কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি।
কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পত্রপত্রিকায় নতুন যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে হতাশার সুর রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কারিগরি শিক্ষায় বিরাজ করছে শুভংকরের ফাঁকি। কারিগরি শিক্ষার্থীর বর্তমান হার ১৪ শতাংশ বলা হলেও আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা অনুযায়ী বাস্তবে এটা ৮.৪৪ শতাংশ। কারণ এ শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে নানাবিধ সংকট। শ্রেণিকক্ষ, ল্যাবরেটরি ও শিক্ষকসংকট মারাত্মক। এক শিক্ষককে দিয়ে চালানো হচ্ছে দুই শিফট। এ নিয়ে শিক্ষকের মধ্যে ক্ষোভ বিদ্যমান। ফলে মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা যেনো সুদূরপরাহত। এই শিক্ষাব্যবস্থা হতে মেয়েরা কেনো বিমুখ হচ্ছে তা অনুসন্ধান করা উচিত। শ্রমবাজারের সঙ্গে অনেক কোর্স-কারিকুলামের কোনো সংগতি নেই। অর্থাৎ সিলেবাস এখনো যুগোপযোগী নয়। কারিগরি শিক্ষা লাভ করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থীরা তেমন একটা সুযোগ পাচ্ছে না, ফলে বাড়তেছে না তাদের সামাজিক মর্যাদা। এ কারণে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি করতে উৎসাহিত হচ্ছেন না।
***কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব যে অপরিসীম তা আমরা অনেক আগে থেকেই অনুভব করতে সক্ষম হই। এ প্রেক্ষাপটে অতি সম্প্রতি শিক্ষার মানোন্নয়নে এক হাজার ৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন করে, যেখানে ১০০টি উপজেলায় একটি করে কারিগরি স্কুল ও পলিটেকনিক নির্মাণ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।সরকার বলছে, মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে তারা। গত সাত বছরে কারিগরি শিক্ষার হার ১১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যেখানে সাত বছর আগে এ হার ছিল মাত্র ১ শতাংশ। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার হার ও এ শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে।কারিগরি শিক্ষা গুরুত্ব পায় যখন সরকার আলাদাভাবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড গঠন করে এবং এ শিক্ষার জন্য নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেয়। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিক থেকে এ শিক্ষা বিশেষ গুরুত্ব পায় এবং ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলে।
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সমপ্রসারণ এবং উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য। “ডিজিটাল বাংলাদেশ” গড়ার প্রত্যয়ে ভিশন-২১ বাস্তবায়ন তথা দারিদ্র বিমোচন, কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, আত্ম-কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সমপ্রসারণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। সর্বোপরি কারিগরি শিক্ষা ছাড়া অধিক জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তর করা অসম্ভব।
অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী বলতে স্বনির্ভর অর্থনীতি, যার অর্থ কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য আভ্যন্তরীণ বিষয়ে উপযুক্ত বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক নিজস্ব প্রযুক্তি সম্বলিত উন্নয়ন আবশ্যক, তার ধারাবাহিকতা এবং মাধ্যম হল কারিগরি শিক্ষা। বিশ্বের উন্নত দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় নিজেকে দক্ষভাবে গড়ে তুলতে হলে এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী করতে হলে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নাই। তাই কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়নে সামগ্রিকভাবেই কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন :
১. কারিগরি শিক্ষার গুণগতমান উন্নত করা ও দক্ষতা অর্জন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার কোর্সসমূহের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ।
২. শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্ক উন্নয়ন, শিল্প কারখানা চাহিদা অনুযায়ী কোর্স কারিকুলাম প্রণয়ন।
৩. ব্যাপকভাবে সমপ্রসারিত বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানসমূহের অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং ল্যাব সুবিধার অভাবে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না।
৪. গ্রামের দরিদ্র ছেলেরা সাধারণত কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের জন্য আসে। আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য ড্রপ আউটের সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। ড্রপ আউটের হার কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
৫. সকল সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যথাযথ মাননিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অবকাঠামো ও জনবলের অভাব।
৬. যারা অষ্টম শ্রেণি পাস করতে পারে না তাদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৭. বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কর্তৃক বিভিন্ন ধরণের এবং মেয়াদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রক্ষিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করা হয়। সকল প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব।
৮. শিক্ষা বাজেটে কারিগরি শিক্ষার চাহিদার তুলনায় বাজেট অপর্যাপ্ত।
৯. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিষয়ে জনসচেতনতা এবং এ বিষয়ে ইতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভাব।
বাংলাদেশ বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে পারলে তারাই হবে দেশের উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিকল্প নাই। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, আত্ন-কর্মসংস্থান, উদোক্তা উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে বিগত বছরগুলোতে তারিগরি ও বৃত্তিমুলক শিক্ষার ব্যাপক সমপ্রসারণ হলেও কারি গরি শিক্ষা নিয়ে রয়েছে একটি মিশ্র মনোভাব। সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার পাশাপাশি রয়েছে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন। প্রশ্ন রয়েছে যথাযথ দক্ষতা অর্জন নিয়েও। শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর কতভাগ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় পড়াশুনা করে তা নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। কারিগরি ও বৃত্তিমুলক শিক্ষার গুরুত্ব ও বাস্তব প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় এর বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো এর বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০১১২ অনুসারে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫,৭৩,৫২৪ জন। এর মধ্যে সাধারণ শিক্ষায় ১২,৩৫,০১৩ জন, মাদ্রাসা শিক্ষায় ২.০৩.১০৯ জন এবং ভোপকেশেনাল শিক্ষায় ১,৩৯,৩৬৯ জন অর্থ্যাৎ নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া মোট শিক্ষার্থীর ৮.৮৬% কারিগরি রও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় পড়াশুনা করে।
২০১৩ সালে মোট ১৩,০১,৯৩০ জন শিক্ষার্থী এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে যার মধ্যে সাধারণ শিক্ষায় ৯,৯২,৩১৩ জন, দাখিল পরীক্ষায় ২,২১,২৫৭ জন এবং ভোকেশনাল শাখায় ৮৮,৩৬০ জন্য অর্থাৎ এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্ধীর ৬.৭৯% কারিগরি শাখার।
এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হল নবম শ্রেণিতে মোট শিক্ষার্থীর ৮.৮৬% কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হলেও এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৬.৭৯% অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষায় ড্রপ-আউট-এর সংখ্যা সাধারণ শিক্ষার তুলনায় অনেক বেশি। ড্রপ-আউট কমানোর জন্য বৃত্তি প্রদানসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
তাছাড়া কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরে আগামী ৫ বছরে যাতে মোট শিক্ষার্থীর ২০% পড়াশুনার সুযোগ পায় এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। তোমধ্যে বর্তম,ান সরকার উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য প্রয়োজনে প্রতিটি উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে।
২০০৯ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় (সাধারণ, দাাখিল ও ভোকেশনাল) মোট ৭,৫০,৫৩৮ জন ছাত্র-ছাত্রী পাস করে তার প্রায় ১৬.৩২% অর্থাৎ ১,২২,৪৫৬ জন শিক্ষার্থী কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষায় ভর্তি হয়। ২০১৩ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট ১১,৫৪,৭৭৮ জন শিক্ষার্থী পাস করে যায় মধ্যে ২,১৫,১৮৬ জন অর্থাৎ ১৮.৬৩% শিক্ষার্থী কারিগরি ও কর্মমূখী শিক্ষায় ভর্তি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে ডিিেপ্লামা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এ। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং এ ২০০৯ সালে ভর্তি হয় ২৭,৬৪০ জন এবং ২০১৩ সালে ভর্তি হয় এর দ্বিগুণেরও বেশি ৫৮,৯১৭ জন অর্থাৎ এসএসসি পাস শিক্ষার্থীদের ৫% এর বেশি ছাত্র-ছাত্রী ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয় যা ২০০৯ সালে ছিল ৩.৬৮%। তাছাড়া ডিপ্লোমা ইন টেঙ্টাইল, এগ্রিকালচার, হেলথ, ফিসারিজ এবং এইচএসসি (ভোক) সহ অন্যান্য কোর্সেও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এইচএসসি (ব্যবসায় ব্যবস্থাপক) কোর্সিট সাধারণ এইচএসসি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে চালু করা একটি কর্মমুখী শিক্ষা। এইচএসসি (ব্যবসায় ব্যবস্থাপক) কোর্সটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২০০৯ সালে এ কোর্সে ভর্তি হয় ৭৬,০৮৪ জন যা ২০১৩ সালে দাঁড়ায় ১,২৪,৬৫৬ (১০৭১%) জনে।
২০১৩ সালে এসএসসি পাস মোট শিক্ষার্থীর ১৮.৬৩% কারিগরে ও কর্মমূখী শিক্ষায় ভর্তি হয় যার মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সসমূহে ৭.৮৪% এবং এইচএসসি (বিএম)-এ ১০.৭৯%। আমাদের লক্ষ্যে হওয়া উচিত ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সসমূহে আগামী ৫ বছরে ভর্তি হবে ১৫% এবং এইচএসসি (বিএম)-এ ১৫%। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন জেলায় এবং বিভাগীয় শহরগুলিতে পলিটেকনিক স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বিদ্যমান পলিটেকনিকগুলিতে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি ও নতুন পলিটেকনিক স্থাপন করে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন।
কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক সমপ্রসারণে বেসকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। দেশের বিভিন্ন শহর ছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে অসংখ্যা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও শিক্ষকের অভাব রয়েছে। কারিগরি শিক্ষা সাধারণ শিক্ষার তুলনায় অনেক ব্যয়বহুল। যে সমস্ত শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় পড়াশুনা করে তাদের বেশির ভাগই মিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাদের টাকায় প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে গড়ে তোলা এবং পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কারিগরি শিক্ষার যথাযথ মান বজায় রাখার জন্য জরুরি ভিত্তিতে বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ শিক্ষক নিয়োগের বেতন সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ ৬ষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাক- বৃত্তিমূলক ও তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালুর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সকল স্কুলে এক সঙ্গে তা চালু করা যাবে না। ধাপে ধাপে তা করতে হবে। এ জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ খুবই জরুরি। একই সঙ্গে এ জন্য উপযুক্ত কারিকুলাম তৈরির পদক্ষেপ নেয়া জরুরি
বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান-২০১২ অনুয়ায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ার উপযুক্ত বয়সের জনসংখ্যা ১৬০ লক্ষ এর মধ্যে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণিতে সাধারণ শিক্ষায় পড়ে প্রায় ৮০ লক্ষ এবং মাদ্রাসায় পড়ে প্রায় ১৭ লক্ষ; বাকী ৬৩ লক্ষ স্কুলেই যায় না। যারা স্কুলে যায় তাদের শতকরা প্রায় ৫০% ই ড্রপ-আউট হয়।
বর্তমানে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থাায় অষ্টম শ্রেণি পাস শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ/শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যুবসমাজের একটি বিরাট অংশ যারা মাধ্যমিক পর্যায়ে ভর্তিই হয় না আবার ভর্তি হলেও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাস করে না তাদের সংখ্যা বর্তমানে ১ (এক) কোটিরও বেশি হবে। তাদের জন্য উপযুক্ত বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষেেণর ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। এই বিরাট নংখ্যক যুব সমাজকে দক্ষ করে কর্মসংস্থানের উপযুক্ত করা গেলে বেকার সমস্যা দূরীকরণের পাশাপাশি অনেক সামাজিক সমস্যার সমাধান করা যাবে।বর্তমানে ৮০ লক্ষেরও বেশি বাংলাদেশী বিদেশে কর্মরত আছে যাদের বেশির ভাগই অদক্ষ। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রয়োজনীয় স্বল্পমেয়াদি কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিদেশে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা গেলে রেমিটেন্সের পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে যেতে খরচ পড়ে বেশি কিন্তু বেতন পায় কম। ফলে জমি, বাড়িসহ যে মূল্যবান সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে যায় সেই টাকাই উপার্জন করতে পারে না। দক্ষ শ্রমিকের বিদেম যেতে খরচ কম হয় বেতনও কয়েকগুণ বেশি।
কারিগরি প্রশিক্ষণের মান ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বল্প পরিসরে সক্ষমতাভিত্তিক প্রশিক্ষণের (ঈড়সঢ়ব:বহপু ইধংবফ :ৎধরহরহম) উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সকল প্রয়োজনীয় ট্রেডের জন্য সক্ষমতাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও জনসচেতনতার অভাব কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার একটি প্রধান অন্তরায়। যদিও বর্তমানে এ বিষয়ে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করে অধিক হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি সবার আগ্রহ বাড়বে।কারিগরি শিক্ষা সাধারণ শিক্ষার তুলনায় অনেক ব্যয়বহুল যা নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। ছাত্রীদের জন্য বর্তমানে প্রচলিত উপবৃত্তির মত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সকল স্তরে উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি ড্রপ-আউট কমবে এবং শিক্ষার গুণগত মানও বৃদ্ধি পাবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সকল স্তরে শিক্ষাথীদের জন্য বৃত্তি প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন পেশার অসংখ্য লোক অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহন করে আসছে। তাদের কোনো সনদ নেই বলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়না। ইতোমধ্যে কিছু কিছু পেশার জন্য পূর্ব প্রশিক্ষণের স্বীকৃতি (জবপড়মহর:রড়হ ড়ভ ঢ়ৎরড়ৎ ষবধৎহরহম) এর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সকল প্রচলিত পেশার জন্য এই উদ্যোগ সমপ্রসারণ করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন যাতে সংশ্লিষ্ট সবাই সনদ পেতে পারে এবং দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে।
কারিগরি শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিন-
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করেছে কারিগরি শিক্ষার ওপর ভর করে। তাদের কৃষি, শিল্প ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি যুগোপযোগী মানসম্মত কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা। অথচ আমাদের দেশের ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন। এখানে কারিগরি শিক্ষার প্রতি সমাজের অনেকেই এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। সামাজিকভাবে ধরে নেওয়া হয় যারা পড়াশুনায় ভালো নয় তারা টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল এডুকেশনে শিক্ষা নিতে আসে। যা আজ আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। এর ফলে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক মহল সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে থাকে। অথচ কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা গ্রহণ করলে দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারত।
যদি কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করা যেত এবং বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো যেত তাহলে দেশে-বিদেশে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হতো। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশের দক্ষ জনশক্তির অর্ধেকেরও বেশি আসে কোরিয়া, চীন, ভারত সহ বাইরের দেশ থেকে যারা আমাদের দেশের গার্মেন্টস, সিরামিক, ওষুধ, ভৌত-অবকাঠামো সহ বিভিন্ন শিল্পে কাজ করে থাকে। অথচ আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক লোক এসব শিল্পে শুধু শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকে। সারা দেশে বিভিন্ন পেশায় বর্তমানে প্রায় ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কর্মরত রয়েছেন যার বেশিরভাগ নাগরিকই বিভিন্ন পেশায় দক্ষ কারিগর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ করতে হচ্ছে এই ধার করা দক্ষ জনশক্তির জন্য। এক সূত্র থেকে জানা যায়, প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা এ সকল বিদেশি দক্ষ জনশক্তির পিছনে ব্যয় করতে হচ্ছে। অথচ কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা গেলে দেশের মধ্যেই দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব হতো এবং এ বিশাল অঙ্কের ব্যয় বরাদ্দের প্রয়োজন হতো না।
যদিও সরকার কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে অতি সম্প্রতি শিক্ষার মানোন্নয়নে ৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি থেকে অনুমোদন করে। সেখানে ১০০টি উপজেলায় একটি করে কারিগরি স্কুল এ্যান্ড কলেজ নির্মাণ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যা সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ ছাড়া বর্তমানে সরকার আলদাভাবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড গঠন করে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেয়। বলাবাহুল্য মেয়েদের কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও আকৃষ্ট করতে মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকারের যুব ও ক্রীড়া এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বেকার যুবক ও মহিলাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক হাজার কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও অনেক এনজিও মেয়েদের ও বেকার যুবকদের সেলাই, ড্রাইভিং ও হস্তশিল্পসহ নানা ধরনের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। তবে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে এসব সরকারি-বেসরকারি পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এ সকল প্রতিষ্ঠান কি যুগোপযোগী শিখন ও শিক্ষণ এর ব্যবস্থা দিতে পারছে? তাদের কোর্স কারিকুলাম কি মানসম্মত? শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত পরিবেশ কি বিদ্যমান? ব্যবহারিক শিক্ষার সকল সুযোগ-সুবিধা কি পর্যাপ্ত? এই বিষয়গুলো এখন ভাবনার দাবি রাখে। তাই এ ব্যাপারে কিছু পরামর্শ তুলে ধরলাম:
****প্রথমত, কারিগরি শিক্ষায় গুণগতমান উন্নয়নে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি কোয়ালিটি অ্যাস্যুয়েরেন্স সেল করতে হবে। যা প্রতিনিয়ত কারিগরি শিক্ষায় গুণগত মানোন্নয়ন কাজ করে যাবে। দ্বিতীয়ত, কারিগরি শিক্ষার প্রতি সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করতে হবে। এ শিক্ষার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরতে হবে। তৃতীয়ত, কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। চতুর্থত, প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় যে সকল অকৃতকার্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে তাদের কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে তাদের আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে। পঞ্চমত, বিশেষ করে মেয়েদেরকে এই কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কারণ মেয়েদের স্বাবলম্বী করতে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। ষষ্ঠত, কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। কারিকুলাম, পাঠক্রম, শিখন-শিক্ষণ ব্যবস্থাকে আধুনিক ও উন্নত করতে হবে।
সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও কারিগরি শিক্ষা যে এখনো যথোপযুক্ত গুরুত্ব পাচ্ছে না তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং এখন সময় এসেছে এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনার। তাই কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনসহ প্রশাসনিক সহযোগিতা খুবই দরকার। অন্যথায় দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা সত্যিই দুরূহ কাজ হবে