অভিযানে গুলি চালাতে পারবেন মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা !
১৭ বছর পর অবশেষে পেশাগত কাজে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি পেলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এখন থেকে মাদকবিরোধী অভিযানের সময় ৯ এমএম আধা-স্বয়ংক্রিয় পিস্তল ব্যবহার করতে পারবেন।
গত ২১ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অস্ত্র সংগ্রহ ও ব্যবহারের সংশোধিত নীতিমালা অনুমোদন করে গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে। তবে গুলি করার ক্ষেত্রে কড়া নিয়ম মেনে চলতে বলা হয়েছে।
অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে- ‘একমাত্র সর্বশেষ পন্থা’ হিসেবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা যাবে। তবে আদেশ প্রদানকারীকে অধিদপ্তর বা নির্বাহী তদন্তে গুলি করার যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হবে। গুলি করার আদেশ দেওয়ার আগে যত দূর সম্ভব বলপ্রয়োগ (যেমন লাঠিপেটা ও অস্ত্রের বাঁট দিয়ে আঘাত) করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করা যাবে না।
মাদক নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে সুরক্ষিত অস্ত্রাগার না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র সংরক্ষণ করতে হবে জেলা প্রশাসকের ট্রেজারি রুম অথবা জেলা পুলিশ লাইনস বা সংশ্লিষ্ট থানার অস্ত্রাগারে।
নীতিমালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত ৫৭৯ জন কর্মকর্তাকে অস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, যত দূর সম্ভব ন্যূনতম বলপ্রয়োগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে হবে। তাতে কাজ না হলে দুই-একটি গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। কোনোভাবেই প্রথমে দুটি ফাঁকা ও সরাসরি একটির বেশি গুলি চালানো যাবে না।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, অধিদপ্তরের ৯০ জন উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক ৯৩ জন, পরিদর্শক ১৮৬ জন এবং উপপরিদর্শক ২১০ জন মোট ৫৭৯ জন ৯ মিমি সেমি অটোমেটিক পিস্তল ব্যবহার করবেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, মাঠপর্যায়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অস্ত্র দেওয়া। কারণ, মাদকবিরোধী অভিযান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হয়। কিন্তু জরুরি অবস্থায় সব সময় প্রয়োজনীয় মাত্রায় সহযোগিতা পাওয়া নিশ্চিত নয়। অনেক মাদক কারবারির কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। ফলে অভিযানের সময় তাদের জীবন ঝুঁকিতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র বহন এবং ব্যবহারের অনুমতি পাওয়ায় মাদকের বিরুদ্ধে আরও কার্যকর ভূমিকা নেওয়া সম্ভব হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বাংলাদেশে মাদক অপরাধ দমনে নোডাল এজেন্সি হিসেবে কাজ করে। অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মরত জনবল নিয়মিত মাদক উদ্ধার অভিযান, মাদক চোরাকারবারিদের গ্রেফতার, মামলার তদন্ত ও পরিচালনার কাজে নিয়োজিত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে এবং অভিযানকালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা ঝুঁকি বিবেচনায় ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (কর্মকর্তা-কর্মচারী) অস্ত্র সংগ্রহ ও ব্যবহার নীতিমালা (সংশোধিত) ২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে। নীতিমালা জারির তারিখ থেকে এটি কার্যকর হবে।
দেশে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধকল্পে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) প্রধান মূল সংস্থা হিসেবে কাজ করে। ২০০৮ সাল থেকে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাদকবিরোধী অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি চাইলেও নানান জটিলতা ও বিভিন্ন পক্ষের আপত্তিতে বিষয়টি ঝুলে যায়।
এই সময়ে অধিদপ্তরের নিরস্ত্র সদস্যরা মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনাকালে অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধারের পাশাপাশি ৭৮টি পিস্তল, সাতটি শটগান, ২৭টি ম্যাগাজিন, ১৭টি রিভলবার, একটি এয়ারগান, এক হাজার এক রাউন্ড গুলি উদ্ধার ও জব্দ করে। মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে বিগত ১০ বছরে অভিযান পরিচালনাকালে অধিদপ্তরের ১২৫ জন সদস্য গুরুতর আহত হন। দুজন প্রাণও হারান।
অস্ত্র ব্যবহারকারী অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় অভিযান চালালেও জরুরি অবস্থায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার আগে প্রয়োজন অনুযায়ী সময়মতো সহযোগিতা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়তো। এছাড়া, মাদক সংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা বেশিরভাগই সশস্ত্র, হিংস্র ও সংঘবদ্ধ হওয়ায় অধিদপ্তরের নিরস্ত্র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হয়।
কারা অস্ত্র পাচ্ছেন, প্রশিক্ষণ কোথায়?
নীতিমালায় বলা হয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মোট জনবল তিন হাজার ৫৯ জন। এর মধ্যে ৯০ জন উপপরিচালক, ৯৩ জন সহকারী পরিচালক, ১৮৬ জন পরিদর্শক এবং ২১০ জন উপপরিদর্শক রয়েছেন। তারা আগ্নেয়াস্ত্র বহন এবং ব্যবহারে অনুমতি পাচ্ছেন। তাদের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে অস্ত্র সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করা হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বা বিজিবি বা আনসার বা পুলিশ বিভাগের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ একাডেমিতে অধিদপ্তরের অগ্রাধিকারভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পরে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য থেকে দক্ষ প্রশিক্ষক তৈরি করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
গুলি করার ক্ষেত্রে মানতে হবে যেসব সতর্কতা
অস্ত্রসংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, গুলি করার প্রয়োজন হলে প্রথমে কারও দিকে তাক না করে আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে হবে। পাশাপাশি হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিতে হবে। ন্যূনতম বলপ্রয়োগ করে লাঠিচার্জ ও অস্ত্রের বাট দিয়ে আঘাতের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এক থেকে দুটি গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এর বেশি গুলি করা যাবে না। ফাঁকা গুলির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে একজন মাদক কারবারির কোমরের নিচে, হাঁটু অথবা পায়ে একটি গুলি করা যাবে।
যেকোনো একজনের দিকে তাক করার সময় খেয়াল রাখতে হবে বর্ষিত গুলি যেন কোনো ক্রমেই পেছনে অন্য কাউকে আঘাত না করে। ঘনবসতি অথবা আবাসিক এলাকায় অথবা সমবেত উচ্ছৃঙ্খল জনতার ওপর গুলিবর্ষণের সময় খেয়াল রাখতে হবে নিরপরাধ জনগণ যেন আঘাত না পায়। গুলি করার পর গুলির খোসা অবশ্যই সংগ্রহের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় বা ভয় পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি না করে। প্রতিটি ক্ষেত্রে গুলির আদেশ প্রদানকারী ব্যক্তি গুলিবর্ষণের আদেশ দেওয়ার যৌক্তিকতা পরবর্তীতে যুক্তিযুক্তভাবে উপস্থাপনের জন্য দায়ী থাকবেন।
গুলি করার পর করণীয়
যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গুলিবর্ষণ করার প্রয়োজন হলে অথবা জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গুলির ঘটনা ঘটলে তা তাৎক্ষণিকভাবে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বা মেট্রো বা জেলা বা বিভাগীয় গোয়েন্দা বা বিশেষ জোন কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা মহাপরিচালককে অবহিত করবেন। অভিযানকারী দলের দলনেতা যত শিগগির সম্ভব মৃতদেহগুলোকে পুলিশ না আসা পর্যন্ত পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন এবং আহতদের হাসপাতালে পাঠাবেন। তিনি গুলির খোসা সংগ্রহ করে ইস্যুকৃত রাউন্ড সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন। প্রতি ক্ষেত্রেই গুলিবর্ষণের পর যথা শিগগির সংশ্লিষ্ট থানায় এজাহার বা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করতে হবে।
গুলির নির্দেশনা
মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা, আসামি গ্রেফতার ও আলামত উদ্ধার, আত্মরক্ষা এবং সরকারি সম্পত্তি- অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, স্থাপনা, যানবাহন উদ্ধার, উদ্ধারকৃত আলামত, আসামি, জব্দকৃত আলামত, সম্পদ রক্ষা করার আইনানুগ অধিকার রক্ষার্থে শক্তি প্রয়োগ তথা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করা যাবে। তবে কোনো অবস্থাতেই অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা যাবে না এবং ঘটনার পর যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্যভাবে বল প্রয়োগ বা গুলিবর্ষণের প্রমাণ দেখাতে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান জাগো নিউজকে বলেন, সরকার আমাদের জন্য অস্ত্রের অনুমোদন দিয়েছে। এটি দীর্ঘদিন ধরে দাবি ছিল। কারণ বর্তমানে অধিকাংশ মাদক কারবারির কাছে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। ফলে অভিযান ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এবার আমাদের অফিসাররা আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করবেন। ইতোমধ্যে পুলিশের সারদা ট্রেনিং সেন্টারে আমাদের সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পরবর্তী প্রশিক্ষণের জন্য আরও কয়েকজনকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ বলেন, মাদক কারবারিদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকায় অভিযানে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হয়েছেন। অপরাধীদের মোকাবিলা করার পাশাপাশি নিজেদের নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার জন্যই আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োজন।
সৌজন্য -জাগো নিউজ