জাতীয়সারাদেশ

আটকে আছে আড়াই লাখ আবেদন পাসপোর্টের ভোগান্তি

Share this:

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে পাসপোর্ট অফিস পুরোদমে চালু না হলেও গ্রাহক ভোগান্তি বেড়েছে। আটকে আছে প্রায় আড়াই লাখ আবেদন। এই সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বৈশ্বয়িক করোনা পরিস্থিতিতে টানা দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে অফিস বন্ধ ছিল। এখন সীমিত পরিসরে অফিস চলছে। এ কারণেই আটকে আছে এত আবেদন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মাত্র দুই সপ্তাহে এ সমস্যার সমাধান হবে।

সরজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন শতাধিক লোক আসছে আগারগাঁও পাসপোর্ট অধিদফতরে। অফিসের সামনে এসে তারা পাসপোর্ট ডেলিভারির বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার যোগাযোগ করতে পারছেন না। অবশেষে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ দালালের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন। কেউ ফিরে যাচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে মিলছে না পাসপোর্ট। অনেকের বিদেশে ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। কারও কারও নতুন চাকরিতে আবেদন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার জন্য আবেদন করতেও নতুন পাসপোর্ট প্রয়োজন। তারা আবেদন করে ঘুরছেন মাসের পর মাস। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, ‘রি-ইস্যু’র জন্য জমা দেয়া পাসপোর্ট নিতে গেলে মিলছে না পাসপোর্ট। অফিস থেকে জানানো হচ্ছে মেসেজ পেলে আসবেন। এদিকে জমা দেয়ার পর ৫/৬ মাস অতিবাহিত করলেও মিলছে না মেসেজ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অফিসের বাইরে দালালদের মাধ্যমে অর্থ খরচ করে মিলছে পাসপোর্ট। তাও অনিশ্চিত। করোনা পরিস্থিতির কারণে পাসপোর্টের নতুন আবেদন বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তা বন্ধ থাকবে। বর্তমানে শুধুমাত্র ‘রি-ইস্যু’র কাজ চালু রেখেছে পাসপোর্ট অধিদফতর।

পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারের শাকিল আহমেদ বলেন, প্রয়োজনীয় গ্রাহক সেবা দিতে পাসপোর্ট অধিদফতর প্রস্তুত। একটি পাসপোর্ট ডেলিভারি দিতে প্রায় ৪০ হাত ঘুরতে হয়। এই অবস্থায় কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে অনেকের দেহে সংক্রামিত হতে পারে। এজন্য কাজের গতি একটু মন্থর। এখন জরুরী ভিত্তিতে কিছু পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে। দিনে প্রায় সাত হাজারের মতো পাসপোর্ট প্রিন্ট করা হচ্ছে। এখন শুধুমাত্র ‘রি-ইস্যু’ পাসপোর্ট প্রিন্ট করা হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দিনে ২০ হাজার পাসপোর্ট প্রিন্ট করা যাবে। সে ক্ষেত্রে দুই লাখ পাসপোর্ট প্রিন্ট করতে মাত্র দুই সপ্তাহ লাগবে। অনেকে ৫/৬ মাস পরও পাসপোর্ট পাচ্ছে না, এ বিষয়ে তিনি বলেন, গ্রাহক আবেদন জমা দেয়ার পর প্রায় আড়াই মাস অফিস বন্ধ। এর পর অফিস খুললেও সীমিত পর্যায়ে কাজ হচ্ছে। কাজের গতি বাড়ানো হচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাসপোর্ট প্রিন্ট করাটা একটি টিম ওয়ার্ক। গতি বাড়াতে গেলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। আর একবার কেউ আক্রান্ত হলে পুরো টিম অকেজো হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে পুরোটা বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। আর পুরোটা বন্ধ থাকার চেয়ে কিছু পাসপোর্ট দিতে পারছি এইটাকি বেশি ভাল নয়? করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে দীর্ঘ ৬৬ দিন বন্ধ ছিল পাসপোর্ট অধিদফতরের সব কার্যালয়। তবে ৩১ মে থেকে অধিদফতর খোলার পরেও বন্ধ রয়েছে নতুন করে পাসপোর্ট দেয়ার কার্যক্রম। এর ফলে আটকে আছে সারাদেশ ও প্রবাসীদের প্রায় আড়াই লাখ পাসপোর্ট আবেদন। বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর জানায়, সাধারণ ছুটির পর ৩১ মে পাসপোর্ট অধিদফতরের কার্যালয়গুলো খুললেও পাসপোর্ট প্রদানের বিষয়ে অধিদফতরের পক্ষ থেকে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনায় বলা হয়, নতুন পাসপোর্টের আবেদন এবং বায়ো-এনরোলমেন্ট বন্ধ থাকবে। যাদের পাসপোর্টের মেয়াদ এখনও ছয় মাসের বেশি রয়েছে তাদের পাসপোর্ট রিনিউ/রি-ইস্যু আপাতত বন্ধ থাকবে।

এদিকে ২০১৯ সালের নবেম্বর মাসে পাসপোর্টের আবেদন করে এখনও পাসপোর্ট পাননি-এমন অনেক ভুক্তভোগী প্রতিনিয়ত ভিড় করছেন পাসপোর্ট অধিদফতরে।

আহমেদ নূর নামের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি গত ১৩ নবেম্বর পাসপোর্টের আবেদনপত্র জমা দিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট-ছবিসহ বায়ো-এনরোলমেন্ট করে আসি। স্লিপে পাসপোর্ট ডেলিভারির কথা বলা হয়েছিল ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর। তবে সর্বশেষ ১৭ জুন পর্যন্ত পাসপোর্ট হাতে পাইনি।’

তিনি বলেন, মেসেজে পাসপোর্ট আবেদন প্রক্রিয়ার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে দীর্ঘদিন ধরে ‘পেন্ডিং ফর পাসপোর্ট পার্সোনালাইজেশন’ লেখা দেখাচ্ছে। চলতি বছরের মার্চে আগারগাঁও পাসপোর্ট গিয়ে খোঁজ করলে তারা জানান, তিন দিন পর দিয়ে দেবে। তবে এখনও পাসপোর্ট হাতে পাইনি। অথচ এক দালাল ২ হাজার টাকার বিনিময়ে তিন দিনে প্রিন্ট করে দেবেন বলে আমাকে জানান। এছাড়া আমার পরিচিত অনেকেই দালাল ধরে ডেলিভারির তারিখের আগেই পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছে।

তারেক মাহমুদ নামের আরেক অবেদনকারী বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন আগে ই-পাসপোর্টের আবেদন করেছিলাম। অবশেষে ৮৭ দিন পর আজ ১৭ জুন পাসপোর্ট হাতে পেলাম।’ পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি ২০১৯ সালের ২৬ নবেম্বর আমার স্ত্রী ও মায়ের জন্য মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) আবেদন করি। সশরীরে ৫-৬ বার আগারগাঁওয়ের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে খোঁজ নিই। তারা বলেন যে দ্রুত হয়ে যাবে। তবে আজ ১৭ জুন, এখনও পর্যন্ত পাসপোর্ট হাতে পাইনি।’ তবে সাত দিনের জরুরী পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে দেড় থেকে দুই মাসে পাসপোর্ট পেয়েছেন- এমন অভিযোগও করেছেন ভুক্তভোগীরা।

এ বিষয়ে বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, করোনাকালীন সময়ে আপাতত বায়ো-এনরোলমেন্ট করার ঝুঁকি রয়েছে। তাই এটা চালু হতে কিছু সময় লাগবে। আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে পরিস্থিতি ভাল হলে আশা করছি দ্রুতই এই কার্যক্রম চালু করতে পারব। তিনি বলেন, করোনার এই সঙ্কটের মধ্যেও পাসপোর্ট প্রিন্টের কাজ চলছে। যাদের জরুরী প্রয়োজন, তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে পাসপোর্ট প্রিন্ট করা হচ্ছে।

পাসপোর্ট অধিদফতরের আরেকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, নতুন পাসপোর্ট দেয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্ট গ্রহীতার ছবি তোলা, ফিঙ্গার প্রিন্ট, আইরিশ পিকচারসহ বেশ কিছু কার্যক্রম রয়েছে, যেগুলো নিয়ে গ্রহীতাকে সরাসরি অফিসে আসতে হবে। এই কার্যক্রম সম্পন্ন করার সময় করোনা ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, ই-পাসপোর্ট ও এমআরপি দুই ক্ষেত্রে নতুন পাসপোর্ট আবেদন বন্ধ রয়েছে। তবে বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশী যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে বা হয়ে যাচ্ছে, তাদের ভিসার আবেদন করার প্রক্রিয়া চালু রয়েছে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পাসপোর্ট প্রদান বন্ধ থাকলেও জরুরী ভিত্তিতে দেশের বাইরে যেতে হবে- এমন অনেকের পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছে। তবে সেক্ষেত্রে প্রমাণপত্র দেখাতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *