অর্থনীতিজাতীয়

তামাক কোম্পানি কর্তৃক প্রচারিত দায়সারা রাজস্ব মিথ

Share this:

বরিশাল ব্যুরো :

সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে গ্রহণ করা হচ্ছে নানা দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক হলেও বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরী করছে তামাক কোম্পানিগুলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে একজন অধূমপায়ীর তুলনায় একজন ধূমপায়ীর করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকি ১৪ গুণ বেশী। এসকল তথ্য জানার পরও তামাক নিয়ন্ত্রনে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য তামাক কোম্পানীগুলো সারা বছরজুড়েই বিভিন্ন কুটকৌশল অবলম্বন করে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো ২০২০-২১ বাজেটে তামাকের উপর বর্ধিত কর প্রত্যাহারের দাবি। অথচ তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি হলো দাম বাড়িয়ে একে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে আনা। এতে একইসঙ্গে তামাকের ব্যবহার কমে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাংলাদেশে জটিল ও ত্রুটিপূর্ণ তামাক কর কাঠামোর জন্য তা তামাক নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। তাই বাংলাদেশে কার্যকর তামাক কর ব্যবস্থার জন্য ‘জাতীয় তামাক কর নীতি’ প্রণয়ন জরুরি।
বহুস্তরভিত্তিক দুর্বল কর কাঠামো এবং তামাকজাত দ্রব্যের ধরণে বিচিত্রতার দরুণ দাম বাড়লে বিকল্প বেছে নেয়ার সুযোগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় রেখে সময়োপযোগী তামাক কর ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবী। প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে সে লক্ষ্য পূরণের জন্য একটি বিস্তৃত তামাক কর নীতি গ্রহণের কথা বলেছেন। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি পূরণে অতি সত্ত্বর জাতীয় তামাক কর নীতি প্রণয়ন করতে হবে। যার মধ্যে করারোপসহ, কর আদায় পদ্ধতি ও পর্যবেক্ষণ, ট্রাকিং ও ট্রেসিং, কর ফাঁকি বন্ধ, আমদানি-রপ্তানি, তামাক করসংক্রান্ত প্রশাসনিক বিষয়াদিসহ তামাক করসংশ্লিষ্ট সকল বিষয়াদি যুক্ত থাকবে।
তামাক ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো থেকে প্রতিবছর সরকারের যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে, পরোক্ষভাবে তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত লোকদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ের জন্য। তামাক সেবনের কারণে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জিডিপিতেও।
তামাক ব্যবহারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করতে আগামী বাজেটে সব ধরনের তামাকপণ্যের ওপর একই হারে উচ্চ মাত্রায় কর আরোপের দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সিগারেটসহ তামাক পণ্যের ওপর যথাযথভাবে কর বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ‘রাজস্ব মিথ’! একক খাত হিসেবে সিগারেট থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে বলে তামাক কোম্পানীগুলো নমো: নমো: ভাব দেখায়। প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, সিগারেট থেকে রাজস্ব আসে তা কী কোম্পানী দেয়? নাকি জনগণ দেয়? সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসুন দেখি কীভাবে জনগণের দেয়া রাজস্বের নিজেদের নামে চালিয়ে বাহবা নিচ্ছে সিগারেট কোম্পানী।
এককভাবে দেশের সিগারেটের বাজারের ৬৪ ভাগ নিয়ন্ত্রণ বহুজাতিক কোম্পানী বিএটি’র হাতে। আর ২০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে আরেক বহুজাতিক কোম্পানী জাপান টোব্যাকো। বাকী ১৬ ভাগ দেশীয় অন্যান্য কোম্পানীর হাতে রয়েছে। যেহেতু সিংহভাগ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তাই বিএটি’র রাজস্ব মিথ আলোচনা জরুরী। ২০১৯ সালে সিগারেট থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ২৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এরমধ্যে ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ-বিএটিবি’র থেকে এসেছে ২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। আর ২২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব দেয়ার কথা বলে এনবিআরের কাছে বিএটি পছন্দমাফিক ‘লাভজনক কর কাঠামো’ আদায় করে নিচ্ছে। ২০১৯ সালের বিএটি’র আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার রাজস্বের মধ্যে মধ্যে সম্পুরক শুল্ক, ভ্যাট, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের (SD+VAT+HDSC) থেকে এসেছে ২১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। আর কাস্টমস ডিউটি (CD) থেকে এসেছে ৩৪০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে SD+VAT+HDSC+CD থেকে রাজস্ব ২১ হাজার ৬৪৩ টাকা। এখানে ২২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার মধ্যে ২১ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকাই বা প্রায় ৯৬ শতাংশই দিয়েছে ভোক্তারা অর্থাৎ- জনগণ! আর বিদেশে রয়্যালিটিসহ সব ধরনের খরচের পর কোম্পানীর আয় থেকে বিএটি আয়কর দিয়েছ মাত্র ৮১৬ কোটি টাকা! যা তাদের মোট আয়ের ৪ শতাংশের কম।
তাহলে সিগারেটের রাজস্বের প্রায় ৯৬ শতাংশ দেয় জনগণ আর কোম্পানী দেয় মাত্র ৪ শতাংশ! অথচ জনগণের দেয়া রাজস্ব কালেক্টর হিসেবে এনবিআরে জমা দিয়ে সবোর্চ্চ রাজস্ব দেয়ার ক্রেডিট এবং পুরস্কার পাওয়ার কথা কী বিএটি’র? এখানেই শেষ নয়, ২০১৯ সালে কর ও বছর বছর মেশিন কেনা, গ্রুপ কোম্পানীকে রয়্যালিটি বাবদ টাকা পাঠানোসহ সবধরনের খরচ শেষে কোম্পানীর লাভ ৯২৫ কোটি টাকা। আয়কর দিয়েছে ৮১৬ কোটি টাকা! তুলনা করলে দেখা যাবে কোম্পানীর লাভ বাড়ছে কিন্তু ইনকাম ট্যাক্স আর আয়কর তেমন বাড়ছে না। সবোর্চ্চ রাজস্ব দেয়ার ক্রেডিটে কী লুকিয়েছে শুভংকরের ফাঁকি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *