জাতীয়বরিশাল বিভাগসারাদেশ

গৌরনদীর গণডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতার: নয়

Share this:

সুজন শরীফ, ষ্টাফ রিপোর্টার : হালের আলোচিত স্পেনিশ ক্রাইম সিরিজ ’মানি হেইস্টের’ এ যেন বাংলাদেশ সংস্করণ! সেই সিরিজের টানটান উত্তেজনা আর শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্যপট স্পেনের ব্যাঙ্কে স্বর্ণ ডাকাতির মতোই নিজের মেধা আর কৌশলে সাভারের আশুলিয়ার ১৮টি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ছক সাজিয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন দেওয়ান (৪০) ।

সিরিজটিতে আলভারো মুর্তের অভিনীত প্রফেসর চরিত্রে স্বয়ং এই আনোয়ার।নেট দুনিয়া কাঁপানো সেই সিরিজটি এখনো চলছে। কিন্তু বিধিবাম । আনোয়ারের সিরিজ ডাকাতিতে বাঁধ সেধেছে নরসিংদী জেলা পুলিশ।অস্ত্র,লুন্ঠিত সোনা,নগদ টাকাসহ দলের ৯ সদস্যসহ ধরা পড়েছেন আনোয়ার । বেরিয়ে এসেছে নয়ারহাট বাজারের ১৮টি সোনার দোকানে স্বাসরুদ্ধকর ডাকাতিসহ সিরিজ ডাকাতির আদ্যোপান্ত । সাভারের আশুলিয়া থানার নয়ারহাট বাজারের ১৮ স্বর্ণের ব্যবসায়ীর কাছে গত ৫ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিলো এক বিভীষিকাময় দিন।

সেদিন নৌপথে আসা ডাকাতরা ১৮টি স্বর্ণের দোকানে হানা দিয়ে লুটে নেয় সর্বস্ব। সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসেন ব্যবসায়ীরাস্মরণকালের ইতিহাসে দুর্ধর্ষ এমন গণডাকাতির ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে ঢাকা জেলা পুলিশ। খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো ডাকাত দলের সন্ধানে যখন ঢাকার গোয়েন্দা,পিবিআই, সিআইডি,র‍্যাবের সদস্যরা গলদঘর্ম তখন নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীমের নেতৃত্বে জেলার গোয়েন্দা পুলিশের জালে আটকা পড়ে সিরিজ ডাকাতির মূল হোতা আনোয়ার হোসেন দেওয়ানসহ দুর্ধর্ষ ৯ ডাকাত।

উদ্ধার করা হয় লুন্ঠিত টাকা, ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত অস্ত্র ও উপকরণ।আটককৃতরা হলেন, ডাকাত সর্দার মো. আনোয়ার হোসেন দেওয়ান (৪০), পিতা-মোহাম্মদ দেওয়ান, সাং-কুন্ডেরচর গনি মল্লিকের কান্দি), মেহের আলী মাতবরের কান্দি, থানা-জাজিরা, জেলা- শরিয়তপুর,(২) কামাল খাঁ (৩৯),পিতা-মোতালেব খাঁ, সাং-বলাইচর, থানা- মাদারীপুর সদর, জেলা- মাদারীপুর,(৩) মো. দেলোয়ার হোসেন খলিফা (৩৬),পিতা মৃত-সিরাজ খলিফা, সাং-দাইমুদ্দিন খলিফার কান্দি, থানা-জাজিরা, জেলা- শরিয়তপুর,(৪) খালেক হাওলাদার (৩৭), পিতা-মো. নূরুল ইসলাম হাওলাদার, সাং-নতুনচর দৌলতখান, থানা-কালকিনী, জেলা- মাদারীপুর

(৫) মো. আল মিরাজ ওরফে মিন্টু (৩৮), পিতা মৃত-হারুন গাজী, সাং- ব্রাহ্মনকাঠী, থানা-বানারীপাড়া, জেলা- বরিশাল,(৬) মো. খবির হাওলাদার (৪০), পিতা মৃত-আ. মান্নান হাওলাদার, সাং-বলাইরচর, কালিকাপুর ইউ.পি, থানা- মাদারীপুর সদর, জেলা- মাদারীপুর,(৭) আব্দুর রহিম মিয়া (৩১),পিতা মৃত- আ. মালেক, সাং-বন্দকাউলজানি, থানা- মির্জাপুর, জেলা- টাঙ্গাইল,(৮) মো. কবির হোসেন (৩৮), পিতা মৃত-আব্দুল করিম, সাং-লক্ষীপুর, থানা-আড়াইহাজার, জেলা-নারায়নগঞ্জ(৯) আ. রহিম মিয়া (৩৯), পিতা-সামসু মিয়া, সাং-ঝাউকান্দি (নিরাতকান্দা), কালাপাহাড়িয়া, থানা-আড়াইহাজার, জেলা- নারায়নগঞ্জ‌।গত ৫ সেপ্টেম্বর রাতে নয়ারহাট বাজারে ১৭টি স্বর্ণের দোকানে ফিল্মি কায়দায় দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় ডাকাতরা আনুমানিক ১২৬ ভরি স্বর্ণালংকার, ৯১২ ভরি রুপার গহনাসহ নগদ ১৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা লুট করে নেয়।

সব মিলিয়ে লুট করা হয় প্রায় এক কোটি ২ লাখ ৩২ হাজার টাকার অলংকারসহ নগদ টাকা।নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম বলেন, ডাকাতদের বৈশিষ্ট্য ছিলো নদীর তীরবর্তী এলাকায় ডাকাতি।প্রতিবেশী দুই জেলায় দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা আমার নজরে আসায় আগে থেকেই জেলার পুলিশ ও গোয়েন্দাদের সতর্ক করে দেয়া হয়। নির্দেশ দেয়া হয়,এই দলটির গতিবিধি পর্যবেক্ষণে।গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ১০ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১২ টার দিকে নরসিংদীর পূর্ব দত্তপাড়া পুরাতন লঞ্চঘাট এলাকার মৃত হাজী নিয়ামত আলীর বাড়ীর দক্ষিণ পার্শ্বে নদীর ঘাটের সিঁড়ি সংলগ্ন বেড়ি বাঁধের ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ১ টি সী-বোট ও ১ টি প্রাইভেটকারসহ অবস্থান নেয় ২৪/২৫ জনের একদল ডাকাত।গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি আবুল বাসারের নেতৃত্বে পুলিশ তাদের তাড়া করে।

এসময় ডাকাতরা পুলিশ কে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করলে গোয়েন্দা পুলিশ পাল্টা গুলি ছোঁড়ে।পালানোর চেষ্টাকালে আটক করা হয় ৯ ডাকাতকে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে সাভারের নয়ারহাটের ১৮ টি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনার আদ্যোপান্ত।নরসিংদীর পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম জানান, দুর্ধর্ষ ডাকাত আনোয়ার দেওয়ানের বিরুদ্ধে অন্তত আটটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের কারাগারেও দীর্ঘদিন বন্দি ছিল সে। তার বাবা মো. দেওয়ান ছিলেন কৃষক। এক সময় গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে বেগম বাজারে পুরোনো কাপড়ের ব্যবসা শুরু করে তারা। ২০১০ সালের দিকে শরীয়তপুরের তার এলাকার বাসিন্দা চাঁন শরীফ, মো. সাগর ও মনির খলিফার সঙ্গে সখ্য হয় তার। তাদের খপ্পরে পড়েই ব্যবসা ছেড়ে শুরুর দিকে শরীয়তপুর-মাদারীপুর এলাকায় গরু চুরি শুরু করে সে।

তবে ২০১৪ সালে পাবনা থেকে একরাতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গরু চুরি করেছিল সে। ১০টি গরু চুরি করে ট্রলারে তা ঢাকায় এনে বিক্রি করে দেয়। এভাবেই চুরি করে হাত পাকিয়ে দল গঠন করে ডাকাতিতে নামে সে।চাঁদপুর, দৌলতদিয়া, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, মুন্সীগঞ্জ,পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডাকাতি ভারতে গা-ঢাকা দেয় আনোয়ার। ২০১৭ সালের দিকে ভারতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয় সে। ২৭ মাস ২০ দিন ভারতের কৃষ্ণনগর জেলে কারাভোগের পর দেশে ফেরে আনোয়ার।“মানি হেইস্টে” সিরিজের প্রফেসরের মতোই চোর আর ডাকাতদের নিজ দলে ভিড়িয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেয় সে।

শুরু করে ফের ডাকাতি। ২০২০ সালে চাঁদপুরের একটি ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কয়েক মাস কারাভোগ করে। জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে আবার সেই পুরোনো পেশায় নামে সে। ডাকাত চক্রের কাছে তার পরিচয় ছিলো ‘দেওয়ান ভাই’।জিজ্ঞাসাবাদে আনোয়ার জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ডাকাতির সুবাদে ১০টি বিয়ে করেছে সে।আশুলিয়ার নয়ারহাটে ১৮টি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনার বিষয়ে আনোয়ার জানিয়েছে, নিজের অগ্রবর্তী দলের কাছ থেকে আগাম তথ্য পেয়ে স্বর্ণের দোকান গুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। ডাকাত দলের সদস্যরা দুই ভাগ হয়ে স্পিডবোট ও ইঞ্জিনচালিত জলযানে সেখানে যায়।

আরেকটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায় মাইক্রোবাসে। বেশিরভাগ সময় শিমুলিয়া ঘাট থেকে মো. শাহিন নামে একজন আনোয়ারকে স্পিডবোট ভাড়া করে দেয়। এক রাতের জন্য ভাড়া পড়ে ২০-৩০ হাজার টাকা। সর্বশেষ গোপালদী বাজারে ডাকাতির জন্য স্পিডবোট ভাড়া করা হয়। আগে থেকে চার-পাঁচটি ভাগে সদস্যদের ভাগ করে দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া থাকে। একটি গ্রুপের কাজ থাকে বাজারের পাহারাদারদের শুরুতেই আটক করে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা। আরেকটি গ্রুপ ঘটনাস্থলের আশপাশে নজরদারিতে থাকে। আরেকটি গ্রুপ থাকে বাজারের মসজিদ এলাকায়, যাতে কেউ মসজিদে গিয়ে বাজারে ডাকাত পড়েছে সেই বার্তা জানিয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজনকে সতর্ক করতে না পারে।

একটি গ্রুপ দোকানের শাটার ভাঙতে ব্যস্ত থাকে। আরেকটি গ্রুপ ভেতরে ঢুকে স্বর্ণালংকার লুট করে ও সিন্দুক ভাঙে। একেকটি ডাকাতিতে অন্তত ২০ জন অংশ নেয়।নরসিংদী পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজিম আরো জানান, অভিযানের শেষ এখানেই নয়। আনোয়ারের টিমের পলাতক অন্যান্যদের ধরতে হন্যে হয়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছে নরসিংদী জেলা পুলিশ। আশা করছি স্বল্প সময়ের মধ্যেই পলাতক ডাকাতদের সবাই আমাদের হাতের নাগালে চলে আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *